বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন প্রকল্পে কার কী অবদান
১৫ আগস্ট ২০২২ ১৯:৫৫ | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২২ ১৮:১৮
পৃথিবীর যে রাজনীতির ইতিহাস, তার পরতে পরতে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায় আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেও বেশ কয়েকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অধ্যায় হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড।
পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনার নেপথ্য নায়কদের পরিচয় ও স্বরূপ উদ্ঘাটনে সাধারণত যুগের পর যুগ কেটে যায়। বিশেষ করে যারা কিলিং মিশনে থাকে, তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, অপারেশন সাকসেস হওয়ার পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা চিরজীবনের জন্য আত্মগোপনে চলে যায়, অথবা সুনির্দিষ্ট ‘ক্লু’ না থাকায় আপাত চিহ্নিত খুনিরা আইনের ফাঁক-ফোকর গিলে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত দু’টি ধারণার কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। কারণ, খুনিরা তাদের মিশন সম্পন্ন করে বীরদর্পে (শব্দটা হওয়া উচিত কাপুরুষদর্পে) জাতীয় বেতারে ‘খুনের ঘোষণা’ দেয় এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত বাংলার মাটিতে বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বাংলাদেশের হয়ে বিদেশি মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
অর্থাৎ খুনিদেরকে আত্মগোপনে যেতে হয়নি। আইনের ফাঁক-ফোকর গিলে বের হওয়ার যে বিষয়টি থাকে, সেটির প্রয়োজন পড়েনি। এখন প্রশ্ন- এমনটি কেন হলো? এর সহজ উত্তর হতে পারে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যারা ক্ষমতায় বসেছে, তারা মনেপ্রাণে ছিল বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী- এক কথায় পরাজিত শক্তির মদদ ও সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠী।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো- বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যারা পুনর্বাসন করেছে তাদের কারও কারও নামের সঙ্গে বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক খেতাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরি এবং পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন। খালেদা জিয়ার আমলেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে ১২ জনকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে শরিফুল হক ডালিম (মেজর ডালিম)-কে করা হয়েছিল চীনের প্রথম সচিব, খুনি আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, বজলুল হুদাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সচিব, শাহরিয়ার রশীদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, নাজমুল হোসেন আনসারকে কানাডায় তৃতীয় সচিব এবং আবদুল সাত্তারকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়োগপত্র ঢাকা থেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনিও বীর উত্তম খেতাব পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তী সময় বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান। অধুনা তিনি বিএনপির সঙ্গে হিাসব-নিকাশ মিটিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। সুযোগ পেলে হয়তো আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়বেন। এ দেশের রাজনীতিতে যা মোটেই অসম্ভব নয়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ‘ফরেন সার্ভিস’ ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি মিশন ও দূতাবাসে উল্লেখিত ১২ সেনা কর্মকর্তা ফরেন সার্ভিসে যোগ দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই হোতা সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আব্দুর রশীদ চাকরি না নিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছা পোষণ করে। তাদের এই খায়েশ পূরণে জিয়াউর রহমান তাদেরকে ব্যবসার মূলধন জোগার করে দেন।
অতঃপর জিয়াউর রহমানের সহযোগিতা এবং লিবিয়ার সৈরশাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির তরফ থেকে পাওয়া মূলধন দিয়ে খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ ত্রিপোলিতে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গড়ে তোলেন। আর সৈয়দ ফারুক রহমান লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি কোম্পানি খোলে। এই কম্পানি জিয়া ও এরশাদের শাসন আমলে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি নিতো।
শুধু চাকরি আর ব্যবসায় মূলধন দিয়ে নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসনে জিয়াউর রহমানের বিএনপি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রয়াত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এরশাদের শাসন আমলে ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ ও কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার হোটেল শেরাটনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার একযুগ পর শোকের মাসের তৃতীয় দিন বাংলার মাটিতে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
ফ্রিডম পার্টি চলত মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির টাকায়। এছাড়া বংলাদেশ-লিবিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি গড়ে তোলে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশিদ। ঢাকায় ব্রাদার গাদ্দাফি কিন্ডারগার্টেন স্কুলও খোলে তারা। আর গাদ্দাফির লেখা গ্রিন বুক বাংলায় অনুবাদ করে জনসাধারণের মাঝে ফ্রি বিতরণের ব্যবস্থাও করে এ দুই খুনি।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা’। পরমযত্নে বঙ্গবন্ধুর যে খুনিদের জিয়া প্রতিপালন করেছেন সেই খুনিদেরই একটি অংশ ১৯৮০ সালের ১৭ জুন সেনানিবাসের অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়। সেই সময় মেজর ডালিম-নূর-হুদা-আজিজ পাশাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে অবশ্য নানাদিক বিবেচনা করে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন জিয়াউর রহমান।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে খুনি ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ওই নির্বাচনের পোস্টারে লেখা ছিল ‘‘আগস্ট বিপ্লবের মহান নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কঃ ফারুকের ঐতিহাসিক জনসভা আজ রোববার ১২ অক্টোবর রপ্তানী মেলা মাঠ, শেরেবাংলা নগর। দলে দলে যোগ দিন।’’ খুনি ফারুক রহমানের নির্বাচনি প্রতীক ছিল বিএনপির নির্বাচনি প্রতীক ‘ধানের শীষের’ মতো।
প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তিকে দাঁড় করাবার লক্ষ্যে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনীতিতে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে খুনি বজলুল হুদাকে মেহেরপুর থেকে এমপি বানানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপির একতরফা নির্বাচনে খুনি রশীদকে বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত করা হয়েছিল।
এই নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে মোটামুটি এটুকু পরিষ্কার যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন প্রকল্পে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অবদান সবচেয়ে বেশি। আবার গত একযুগ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র স্বৈরশাসক প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টির অবদানও কম নয়। বিদেশি শক্তির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এ প্রকল্পে ঢের অর্থ ব্যয় করেছে। এ ক্ষেত্রে লিবিয়ার স্বৈরশাসক প্রয়াত মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি ছিল সবচেয়ে এগিয়ে।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আসাদ জামান টপ নিউজ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন প্রকল্পে কার কী অবদান