Sunday 16 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পোশাক পরিধান না করি

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৬:১৭

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা অন্যতম। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় খাদ্যের পরেই বস্ত্রের প্রয়োজন । এমনকি মৃত্যুর সময়ও মানুষকে এক প্রস্থ সাদা কাপড় নিয়ে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হয়। এক কথায় মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বস্ত্র বা কাপড়ের প্রয়োজন । সুতরাং আমাদেরকে কাপড় ক্রয় বা পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যাতে সেই পোশাক পরিবেশ বান্ধব হয় এবং তা যেন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়। প্রাচীনকালে বেশিরভাগ কাপড় তুলা, উল, সিল্ক এবং পাটের মতো প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত তন্তু দিয়ে তৈরি করা হতো। এই তন্তুগুলি ঐতিহ্যবাহী, পরিবেশবান্ধব এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকারক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ড্রেপারি, বিছানাপত্র, অটোমোবাইল আসবাবপত্র, অফিস, স্কুল এবং হাসপাতালে ব্যবহৃত অনেক কাপড় সিন্থেটিক তন্তু দিয়ে তৈরি। এগুলি ক্ষেত্র বিশেষে অত্যন্ত বিষাক্ত এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই কৃত্রিম কাপড়গুলি পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। আমার এ লেখা বিশেষত: সিন্থেটিক এবং আধা-সিন্থেটিক তন্তুর মাধ্যমে তৈরীকৃত কাপড় বা পোশাকের ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক প্রভাব সমূহ তুলে ধরা।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোকেমিক্যাল থেকে প্রাপ্ত সিন্থেটিক ফাইবার পলিয়েস্টার প্রথম বাজারে আসে ১৯৪০-এর দশকে। পরবর্তী দশকগুলিতে এর কম উৎপাদন ব্যয়,যত্নের সহজতা, রং বৈচিত্রতা, বলিরেখা এবং সংকোচনের প্রতিরোধী গুণের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। টেক্সটাইল শিল্পের একটি প্রধান উপাদান পলিয়েস্টার যা পোশাক, গৃহসজ্জা এবং শিল্প পণ্য সহ বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এরূপ কৃত্রিম পলিয়েস্টার সুতায় কাপড় তৈরির মহাযজ্ঞে দূষিত হয়ে পড়ছে বিশ্বপরিবেশ। উপরন্তু এটি তৈরি করতে গিয়ে যে ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। একইভাবে পরিবেশে বাড়ছে দূষণ ও ব্যবহারকারি হিসেবে নানাবিধ রোগে ভুগছে মানুষ।

বিজ্ঞাপন

হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এবং হাস্যরস ম্যাগাজিন অ্যানালস অফ ইমপ্রোবেবল রিসার্চ দ্বারা আয়োজিত একটি ব্যঙ্গাত্মক পুরস্কার প্রতিবছর প্রদান করা হয়। এটি এমন একটি উদ্ভাবন যা অস্বাভাবিক বা হাস্যকর বৈজ্ঞানিক অর্জনের জন্য প্রদান করা হয় যার লক্ষ্য ‘প্রথমে মানুষকে হাসায় এবং তারপর তাদের ভাবিয়ে তোলে’। ২০১৬ সালের প্রজনন চিকিৎসার জন্য কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ আহমেদ শফিককে পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি ১৯৬৭ সালে মূত্রাশয় প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং যৌন শারীরবিদ্যার উপর শত শত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

ডা: শফিক আহমেদ ১৯৯৩ সালে ইউরোপীয় জার্নাল অফ ইউরোলজিতে Effects of Different Textiles on Sexual Activity শিরোনামে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তিনি ১০০ টি পুরুষ ইদুরকে পাঁচটি দলে ভাগ করেন এবং প্রথম দলটিকে বিশেষভাবে ডিজাইন করা সিন্থেটিক অন্তর্বাস পরানো হয়। দ্বিতীয় দলটি ৫০/৫০ সুতি-পলিয়েস্টার মিশ্রণ, তৃতীয় দলটি সম্পূর্ণ সুতির পোশাক এবং চতুর্থ দলটিকে সম্পূর্ণ উল পরিধান করানো হয়। পঞ্চম দলটি ছিল একটি নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী এবং সমীক্ষা জুড়ে নগ্ন ছিল। নগ্ন দলের চেয়ে সিন্থেটিক অন্তর্বাস পরানো ইদুরগুলোর ইরেক্টাইল ডিসফাংশন এবং পেনিট্রেশনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সম্পূর্ণ সুতি পরা ইদুর গুলো নগ্ন নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীর তুলনায় বেশি ইরেক্টাইল এবং পেনিট্রেশন ক্ষমতা প্রদর্শন করে। ডা: শফিক এ পরীক্ষায় প্রমাণ করেন সিনথেটিক কাপড় পরিধান যৌন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ডা: শফিক আরো একটি গবেষণার মাধ্যমে সিনথেটিক কাপড় যে যৌন স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর তা প্রমাণ করেন। তিনি ইঁদুরের পরিবর্তে কুকুরের গায়ে উপরোক্ত পদ্ধতিতে সিন্থেটিক, ৫০/৫০ সুতির পলিয়েস্টার মিশ্রণ, তৃতীয় দলটি সম্পূর্ণ সুতির পোশাক এবং চতুর্থ দলটি সম্পূর্ণ উল পরিধান করানো হয়। পঞ্চম দলটি ছিল একটি নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী এবং সমীক্ষা জুড়ে নগ্ন ছিল। এবার তিনি শুক্রাণুর সংখ্যা, শুক্রাণুর গতিশীলতা এবং প্রজননের সাথে জড়িত বিভিন্ন হরমোনের ওঠানামা পরিমাপ করে উর্বরতার উপর পলিয়েস্টার বা সুতির অর্ন্তবাস এর প্রভাব লক্ষ্য করেন। এমনকি তিনি টেস্টিকুলার বায়োপসিও করেছিলেন। ইঁদুরের মতো, তাপমাত্রার প্রভাব এড়াতে ‘অণ্ডকোষ’ স্ক্রোটাল অঞ্চলে আলগা ফিটিং করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। সিনথেটিক গ্রুপে, অস্বাভাবিক আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে শুক্রাণুর সংখ্যা এবং শুক্রাণুর গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল। টেস্টিকুলার বায়োপসিতেও অবক্ষয়জনিত পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। হরমোনের মাত্রায় কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। বিপরীতে, তুলা পরা কুকুরগুলিতে উপরে উল্লিখিত কোনও প্যারামিটারে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। সিনথেটিক পোশাক অপসারণের পরে ১২টি কুকুরের মধ্যে ১০টিতে যৌনতার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। গবেষণায় প্রমাণিত হয় সিনথেটিক কাপড় এবং ত্বকের মধ্যে ঘর্ষণে একটি ইলেকট্রস্ট্যাটিক চার্জ তৈরি হয় যা কিলোভোল্টমিটার ব্যবহার করে পরিমাপ করা হয়। Boise State University এর ২০২১ সালের Assessment of Electrostatic Potential Resulting from Friction Between Fabric Samples Made of Natural and Sznthetic Fibers নামক একটি গবেষণা পত্রে দেখানো হয় সিন্থেটিক কাপড় পরিধানে ইলেকট্রস্ট্যাটিক চার্জ বেশি উৎপন্ন হয় যা অণ্ডকোষকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং শুক্রাণুর সংখ্যা এবং শুক্রাণুর গতিশীলতাকে কমিয়ে দেয়। সূতী কাপড়ের অন্তর্বাস পরিধান করলে ইলেকট্রস্ট্যাটিক চার্জ এর পরিমাণ অনেক কম থাকে যা যৌন স্বাস্থ্যের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে না।

সিন্থেটিক পলিয়েস্টার পরিবেশবান্ধব নয়। প্রায় ২০০ বছর সময় লাগে পরিবেশে রিসাইকেল হতে। এই সময়ের মধ্যে পলিয়েস্টারের রাসায়নিক উপাদান পরিবেশে মিশে মাটি, জল, বাতাসের ক্ষতি করে। রাসায়নিকভাবে তৈরি পলিয়েস্টারে কার্সিনোজেনিক উপাদান থাকে যা ক্যানসারের জন্য দায়ী। পলিয়েস্টারের পোশাক দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার করলে এর ফ্যাব্রিকের রাসায়নিক উপাদান শরীরে ঢুকে কোষের সঙ্গে মিশে ত্বকের সংক্রমণজনিত রোগ বা স্কিন ক্যানসার হতে পারে। হার্ট ও ফুসফুসের ক্যানসারের কারণও হতে পারে পলিয়েস্টার। বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, রাসায়নিক ফ্যাব্রিকের উপাদান শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছে কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে। শ্বাসকষ্টের কারণও হতে পারে পলিয়েস্টার।

প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কাপড় পরিত্যক্ত হয়। আর সেগুলো কেবল ল্যান্ডফিল করতে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে যত পানি ব্যবহৃত হয়, তার শতকরা ২০ ভাগ খরচ হয়ে যায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। ল্যান্ডফিলকৃত পোশাক বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ করে নানাভাবে পরিবেশ দূষণ করে। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন অনুসারে, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটা পর্যায়ে-স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, পোস্ট কনজিউমিং-প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয় বর্জ্য। ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ফ্যাশনশিল্পের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বর্জ্য নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে ভোক্তার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। এই নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার অন্যতম সমাধানের নাম টেকসই ফ্যাশনশিল্প যা সিনথেটিক ফাইবার থেকে কাপড় উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করা।

১৯৮৪ সালে একটি গবেষণায় সিন্থেটিক কাপড় তৈরির টেক্সটাইল কারখানায় কর্মরত ২৪,০০০ শ্রমিকের ওপর ১৪ বছর ব্যাপী একটি গবেষণা পরিচালনা করে দেখা যায় শ্রমিকদের মধ্যে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের প্রবণতা বেশি। কাপড়ের বলিরেখা প্রতিরোধ করতে, উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে এবং নতুনত্ব বজায় রাখতে ফরমালডিহাইড নামক একধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়।তাছাড়া ফরমালডিহাইড কাপড়কে শক্তিশালী করে, পোশাকের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে,পরিবহনের সময় বিশেষ করে আর্দ্র আবহাওয়ায় ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করে। ফরমালডিহাইড কাপড়ের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও ব্যবহারকারীর জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতিকর। The International Agency for Research on Cancer এর মতে মানুষ এবং প্রাণী উভয়ের গবেষণায় ফর্মালডিহাইডের সংস্পর্শের সাথে ফুসফুস এবং নাকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় । EPA (Environmental Protection Agency) এটিকে সম্ভাব্য মানব কার্সিনোজেন হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। ফরমালডিহাইডের তীব্র সংস্পর্শে আসার ফলে শ্বাসকষ্টের লক্ষণ, চোখ, নাক এবং গলায় জ্বালা হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে আরও গুরুতর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এটির সরাসরি সংস্পর্শে আসার ফলে ত্বকের জ্বালা এবং অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ফর্মালডিহাইডের সংস্পর্শ প্রজনন এবং বিকাশগত স্বাস্থ্য উদ্বেগের সাথে সম্পর্কিত, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। গবেষণায় ইউরিয়া-ফর্মালডিহাইড রেজিন ব্যবহারকারী মহিলা কর্মীদের মধ্যে মাসিকের ব্যাধির (menstrual disease) বৃদ্ধির ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে।কানাডা, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলি ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত ব্যবহার্য্যের জিনিসপত্রের যত্নে ফর্মালডিহাইডের উপর বিধিনিষেধ বা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যক্তিগত যত্ন পণ্যের বাইরে ফর্মালডিহাইডের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। ২০২৬ সালের আগস্ট থেকে তারা আসবাবপত্র এবং পোশাকের মতো পণ্যগুলিতে ফর্মালডিহাইডের অনুমোদিত মাত্রা সর্বোচ্চ ০.০৬২ মিলিগ্রাম/মিটার/ঘনমিটার এবং অন্যান্য জিনিসের জন্য ০.০৮০ মিলিগ্রাম/মিটার/ঘনমিটার নির্ধারণ করেছে। ২০২৭ সালের মধ্যে ব্যবহৃত কার/জিপ বা মাইক্রো গাড়িগুলিকেও এই মানদণ্ড পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। নিজেদের এবং আমাদের পরিবারকে রক্ষা করার স্বার্থে ভোক্তা হিসেবে এ বিপদগুলো সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। সেইসাথে পোশাক উৎপাদনকারি শিল্পতেও পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ বিকল্পগুলিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।

যখন কোন ক্রেতা কাপড়ের দোকানে প্রবেশ করে প্রথমেই তার দৃষ্টি নিবিষ্ট থাকে কাপড়ের রঙ পছন্দের দিকে। কাপড়ের বিভিন্ন রঙ তৈরীতে ৮০০০ এর অধিক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত থাকে। যে কোনো কারখানায় ০১ টন কাপড়কে রঙিন করতে ২০০ টন বিশুদ্ধ জল ব্যবহার করতে হয়। ফলে একদিকে যেমন অধিক বিশুদ্ধ জলের অপচয় হয় আবার অন্য দিকে এই জল দূষিত হয়ে পরিবেশ তন্ত্রে মিশে যায়। কাপড়কে উজ্জ্বল এবং রঙের ঔজ্জ্বল্যতা প্রদান করতে ‘অ্যাজো’ নামে এক ধরণের রঙ ব্যবহার করা হয়। এই রঙে ক্যান্সার সৃষ্টির উপাদান কার্সিনোজেন থাকে। আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ ত্বক যার ওজন প্রায় ৩.৬ কিলোগ্রাম এবং আয়তন ২ বর্গমিটার। রাসায়নিকভাবে তৈরী এরূপ কাপড় পরিধান করা হলে বিশেষ করে পলিয়েস্টার শার্ট পরে থাকলে এতে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলো আমাদের শরীরে শোষিত হয় এবং স্কিন ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগ ব্যধির সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় অস্ত্রোপচার করা রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ফুসফুসের টিস্যুর নমুনায় ১৩ জনের মধ্যে ১১ জনের ফুসফুসে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গর্ভবতী মহিলাদের প্লাসেন্টাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে এবং গর্ভবতী ইঁদুরের উপর একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং অজাত ভ্রুণের অন্যান্য অঙ্গগুলির মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হয়।

ম্যালাকাইট গ্রিন হল একটি ট্রাইফেনাইলমিথেন রঞ্জক যা জলজ চাষে অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি খাদ্য, টেক্সটাইল, চামড়া, কাগজ এবং রঙ শিল্পেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় (Srivastava et al. 2004; Han et al. 2020)। এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। Srivastava et al. (2004) রিপোর্ট করেছেন যে এটি স্তন্যপায়ী কোষের জন্য অত্যন্ত সাইটোটক্সিক, জিনোটক্সিসিটি, কার্সিনোজেনিসিটি এবং টেরাটোজেনিক বৈশিষ্ট্য সহ।

মেটানিল ইয়েলো নামে একটি রজ্ঞক যা খাদ্য, পানীয়, সাবান, স্পিরিট ল্যাকার, জুতার পালিশ, কাঠের রঙ, চামড়ার রঙ, কালিতে এবং রঙিন কাগজ তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় (Anjaneya et al. 2011)। এটি কার্সিনোজেনিক, জিনের প্রকাশকে পরিবর্তন করতে পারে এবং শুক্রাণু উৎপাদনের হার হ্রাস করতে দেখা গেছে।

মিথাইল অরেঞ্জ নামের আর একটি রজ্ঞক টেক্সটাইল শিল্পে এবং পরীক্ষাগারে সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিষাক্ত এবং মিউটেজেনিক যা জলজ প্রাণীর উপর তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে (Tan et al. 2016)।

পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। জীবন রক্ষার মতোই পরিবেশ রক্ষাও অতি গুরুত্বপূর্ণ। এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রতি বছর ২৮ শতাংশ মানুষ পরিবেশ দূষণজনিত রোগে মারা যায়। বিভিন্ন প্রকার দূষণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকলেও সিনথেটিক কাপড় ও অতিমাত্রায় কাপড়ের ব্যবহারও যে পরিবেশ দূষণের কারণ তা এখনো পরিবেশবাদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি। প্রয়োজনে তুলনায় অধিক কাপড় তৈরীতে যেমন অতিরিক্ত পানি ও বিদ্যুতের প্রয়োজন তেমনি কাপড় পরিস্কার ও রক্ষানাবেক্ষনে উল্লেকিত উপাদান সমূহের বাড়তি অপচয় ঘটে। অনেক সময় আমরা এতটাই সৌখিন ও আধুনিক হচ্ছি যে, লজ্জা নিবারণ ও পরিবেশের বিরুপ প্রকৃতি থেকে বাঁচার জন্য পোশাক পরিধানের যে উদ্দেশ্য তা ভুলেই যাচ্ছি। বিষয়টি একটি কল্পিত ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরছি। প্রাচীনকালের কোনো এক রাজার হঠাৎ মাথায় কি যেন চেপে বসল যে তিনি এমন এক ধরণের দামি পোশাক পরিধান করবেন যাতে সেই পোশাক কেউ দেখতে না পায়। সেটি জানতে পেরে একদল বাটপার তাঁতি সেজে যন্ত্রপাতি নিয়ে ঐ রাজ্যে প্রবেশ করে রাজাকে বলল যে, তারা এত মসৃণ, সূক্ষ্ম ও উন্নত মানের কাপড় তৈরি করতে পারে যা চোখেই দেখা যায় না। রাজা মহাআনন্দিত হয়ে এমন কাপড় তৈরীর আদেশ দিলেন। বাটপারের দল বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে এমনভাবে রাত-দিন কাজ করার ভান করছিল যেন সত্যি সত্যি তারা কিছু বানাচ্ছে। কিছুদিন পর বাটপারের দল বিশাল আয়োজন করে রাজাকে সেই নতুন পোশাক পরানোর চমৎকার অভিনয় করল। রাজা খুশি হয়ে মোটা অংকের টাকা বকশিস দিলেন আর তা নিয়ে বাটপাররা পালিয়ে গেল। বাস্তবে রাজার পরনে কোনো কাপড়ই ছিল না। অর্থাৎ রাজা ছিলেন ন্যাংটা। কিন্তু চাটুকার সভাসদরা বলতে পারছিলেন না যে রাজা ন্যাংটা। দুপাশে হাজারো জনতার মাঝ দিয়ে রাজা যখন যাচ্ছিলেন, তখন চাটুকাররা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে রাজার সেই নতুন পোশাকের প্রশংসা করতে লাগলেন। রাজার এ নতুন পোশাকের খবর শুনে এক স্কুল ছাত্র ভিড় ঠেলে রাজাকে দেখে চিৎকার করে বললো রাজার পরণে কোন কাপড় নেই, রাজা মহাশয় ন্যাংটা। চাটুকাররাও যে যার মতো দৌড়ে পালালো। রাজাও বুঝতে পারল যে তিনি আসলেই ন্যাংটা। কিন্তু ততক্ষণে রাজার ইজ্জতের যা হবার তা হয়ে গেছে।এ গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও উচিৎ হবে পরিবেশ বান্ধব কাপড় পরিধান করা। অতি আধুনিকতার নামে এমন কোন পোশাক পরিধান করা যাবে না তা যেন আমাদেরকে রাজার অবস্থা বানিয়ে দেয়। আমাদের পরিধেয় বস্ত্রটি যেন আমাদের লজ্জা নিবারণের পাশাপাশি লাইফ সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

ক্ষতিকর পোশাক প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর