Sunday 16 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পল্লিকবির পল্লিকথা

সাধন সরকার
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৩:৫৬ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:৫৮

তার মতো করে পল্লির প্রকৃতি-পরিবেশ লেখায় তুলে আনতে পারেননি কেউ। পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯০৩। লেখকের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে। তিনি পল্লি কবি হলেও গ্রাম্য নন। তিনি সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম। গ্রাম-বাংলাকে এমন এক রূপে আবিষ্কার করেছেন যা আর কারো পক্ষে তুলে আনা সম্ভব হয়নি! বাংলার সবুজ ঐশ্বর্যকে কলমে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন ঐশ^র্যময়। তার কবিতায় গ্রাম-বাংলার প্রকৃতির কোনো অনুষঙ্গ বাদ যায়নি। পল্লির নদী-নালা, খাল-বিল, শস্যক্ষেত, বৃক্ষ, মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-খামার, নিসর্গ সবই স্থান পেয়েছে তার রচনায়। ছোটবেলায় পল্লীর বন-পাখি দেখে তার মন উদাস হয়ে পড়তো। পদ্মার তীরে বসে মন কত ছবিই না আঁকতো! তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও কথাসাহিত্যিক। ছোটবেলায় যে ছেলেটির শৈশব কেটেছে গ্রাম্য খড় আর নলখাগড়া দিয়ে ঘেরা ঘরে, যে ছেলেটিকে স্বপ্ন পূরণ করতে অপর বাংলায় চলে যেতে হয়েছিল, কে জানতো সেই ছেলেটিই একসময় গ্রাম্য-বাংলার প্রকৃতি তুলে ধরবেন সাহিত্যের বিশ্বদরবারে। বালক জসীম উদ্দীনকে একটা সময় পথে পথে চিৎকার করে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হয়েছিল। তখনো পদ্মাপাড়ের ছেলেটির মনে ছিল পল্লীর রূপ-রসমিশ্রিত কবিতা।

বিজ্ঞাপন

‘জসীম উদ্দিন স্মৃতিকথাসমগ্রে’ বর্ষার বনের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি লিখেছেন: ‘আষাঢ় মাসে বনের শোভা বড়ই সুন্দর রূপ ধারণ করে। এখানে-সেখানে শ্যামালতা, তৈলাকুচ লতা, আমগুরুজ লতা সবাই যুক্ত করিয়া সেই বেতবনের উপর নানারূপ সুনিপুণ কারুকার্য করিতে থাকে। এখানে-সেখানে দু-একটি হিজল গাছ রাশি রাশি রাঙা ফুল ছড়াইয়া সেই বনভূমিতে দেবকন্যাদের পায়ের অলক্তক রাগের চিহ্ন আঁকিয়া দেয়। এ-ডালে ও-ডালে কানাকুয়া ডাকে, ঘুঘু ডাকে। দূরের ধানক্ষেত হইতে কোড়ার ডাক কানে আসে। আমি দুই চোখ মেলিয়া বনের শোভা দেখিতাম’ (পৃষ্ঠা- ১৮২)।

বিজ্ঞাপন

‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় কবি সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন এভাবে-‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি।’ কবির বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতহীন কুমার নদ। যে নদকে ঘিরে রয়েছে অনেক স্মৃতি। নদীর পাড়ে বসে কবি একলা মনে পালা গান, কবি গান, যাত্রা গান নিজে নিজে চর্চা করতেন।

মা-মাটি আর মানুষকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন কবি জসীম উদ্দিন। মায়ের হাতে পিঠা খেতে পছন্দ করতেন তিনি। স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন, ‘আমাদের গরীবের সংসার। ঘি-ময়দা-ছানা দিয়ে জৌলুশ পিঠা তৈরির উপকরণ মায়ের ছিলো না। চাউলের গুঁড়া আর গুড় এই মাত্র মায়ের সম্পদ।’ কবি পুতুল ভালোবাসতেন। পৈত্রিক বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য কবির প্রিয় মাটির পুতুলগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কবির অমর সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতা। কবি লিখেছেন- ‘ওই খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’ কবি জানতেন না একসময় তার কবরের পাশেও ডালিম গাছ থাকবে! প্রিয় দাদির মতো পল্লী কবিও গভীর ঘুমে শায়িত আছেন ডালিম গাছের তলে। পল্লি-প্রকৃতির কবি শুয়ে আছেন প্রকৃতির প্রকোষ্ঠে।

‘রাখাল ছেলে’ কবিতাটিতে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপের দেখা পাওয়া যায়। ‘ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ/কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা।’ বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলোর একটি পল্লী বর্ষা। এ কবিতায় গ্রামীণ মায়াবী আবহ তুলে ধরা হয়েছে। ‘পল্লী বর্ষা’ কবিতায় কবি লিখেছেন- ‘বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,/সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।/কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা/তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া! কবি জসীম উদ্দীনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতা শিশু বয়সে কার না পড়া হয়নি! সহজ সরল ভাষায় কবির কী অসাধারণ বর্ণনা। ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা /ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে /মামার বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে/আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে /রঙিন করি মুখ…।’

ঢাকা শহরে কবির বাড়ি ছিল কমলাপুরে। এ বাড়িতে কবি গ্রামীণ পরিবেশে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। বাড়িটি ছিল বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় পরিপূর্ণ। পাখিদের আকর্ষণ করার জন্য কবি গাছের ডালে কলস ঝুঁলিয়ে রাখতেন। পাখিদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কবি এমনটি করতেন। পাখিদের খাওয়ার জন্য গাছের নিচে খাবার ছড়িয়ে রাখতেন। বাড়ির বাগানের সবুজ গালিচায় কবি ভক্তদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। কবি মনেপ্রাণে গ্রাম ভালোবাসতেন। গ্রামের রূপ, রস, গন্ধ, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে সেই ছোটবেলা থেকেই। জসীম উদ্দীনের লেখায় এসেছে ওষধি গাছ ভেন্নার কথা। একসময় জনপদের বনে-বাদাড়ে, পুকুর পাড়ে, রাস্তার ঝোপঝাড়ে, গ্রামীণ বাড়ির আঙিনায় ঔষধি গুণে ভরা ভেন্না গাছ দেখা যেত। জনশ্রতি আছে- ভেন্না গাছ, পাতা ও তার ফল থেকে তেল তৈরি হতো। অসুখ-বিসুখে গ্রামাঞ্চলের মানুষের সেই তেল ব্যবহার করতেন। কবি তার বিখ্যাত ‘আসমানী’ কবিতা তুলে এনছেন ভেন্না গাছে কথা। ‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।/বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।’অসাধারণ ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ ভেন্না গাছ কালেভদ্রে দেখা গেলেও সময়ের পরিক্রমায় প্রায় বিলুপ্তির পথে এই গাছ!

বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব কবি জসীম উদ্দীনের। কবিতায় তুলে ধরেছেন প্রাণ-প্রকৃতির কথা। ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে কবির সেই বিখ্যাত পক্তি কারো অজানা নয়! ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে’ কবিতায় সুর তুলেছেন এভাবে- ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে/রে ভোমরা/নিশিতে যাইও ফুলবনে।/জ্বালায়ে চান্দের বাতি/আমি জেগে রব সারা রাতি গো;/। কবির সৃষ্টি লোকসঙ্গীত, জারি, ভাটিয়ালি ও চলচ্চিত্রের গানেও রয়েছে গ্রাম্য প্রাণ-প্রকৃতির কথা। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানের মধ্যে রয়েছে- চারাগাছে ফুল ফুইটাছে…, সুরের বাশিরে…, ফুলের কানে… উল্লেখযোগ্য। ‘নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে’ কবিতায় এসেছে নদীর কথা- ‘ নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে;/আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব/কাহারে শুধাইরে?’ মোটাদাগে বলতে গেলে বলতে হয় কবির প্রায় সব কবিতায় প্রকৃতির কোনো না কোনো উপাদান সচেতনভাবে স্থান পেয়েছে। যেমন- হুলুদ বাঁটিছে মেয়ে, রূপ, নকশী কাঁথার মাঠ, পল্লী জননী, আমার বাড়ি, ধান ক্ষেত, রাখালী, জলের কন্যা, উজান গাঙের নাইয়া, পুরান পুকুর, নীড়, উড়ানীর চর, কমলা রাণীর দীঘি, উপহার ইত্যাদি।

গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকে কবি আরও গভীরভাবে দেখেছেন যখন তিনি লোক-সাহিত্য সংগ্রহের কাজে ঘুরে বেরিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রাম-বাংলায়। ছোটবেলায় কবি প্রকৃতির প্রতি চরম আকৃষ্ট ছিলেন। নিজ বাড়িতে নিজ হাতে পরিচর্যা করে সুন্দর একখানা বাগান গড়ে তুলেছিলেন। গ্রামে ঘুরতে আসা এক ব্রাহ্মণ বালক কবি জসীম উদ্দীনকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন বাগান দেখতে এসে ব্রাহ্মণ খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কবি তার ‘জীবনকথা’ স্মৃতিগ্রন্থে তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘পাতাবাহারের গাছগুলি দেখিয়া তিন বড়ই খুশী হইলেন। আমাকে কানে কানে বলিয়া দিলেন, এই গাছগুলির কাছে আসিয়া তুমি মনে মনে বলিবে, এই পাতাবাহারের মত সুন্দর একটি বউ যেন আমার হয়। এরপর এই পাতাবাহারের কাছে পানি দিতে আসিয়া কেমন যেন লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিতাম। হয়তো মনে মনে দুই একবার বলিতামও, গাছ তোমার মতো সুন্দর বই যেন আমার হয়।’ কবির আত্মজীবনী ‘জীবনকথা’য় যতটা না প্রাধান্য পেয়েছে তার নিজের কথা তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে প্রকৃতির কথা, মায়ের কথা। কবি যেন এক রূপমুগ্ধ পর্যটক। নিজ গ্রামের প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান দেখেছেন একজন স্বদেশী পর্যটকের চোখে। আর তুলে এনেছেন কলমের মাধ্যমে। পল্লী প্রকৃতির কথা জানিয়ে দিয়েছেন বাঙালি পাঠকদের। ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে মাত্র ৭৩ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

সারাবাংলা/এএসজি

জসীম উদ্‌দীন পল্লিকবি মুক্তমত সাধন সরকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর