নদীর শেষকৃত্য নয়, হতে হবে রক্ষায় দায়িত্বশীল
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৪ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৬
বাংলাদেশকে বলা হয় নদী মাতৃক দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি-কালচারের সাথে নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শুধু তাই নয় মানুষের জীবনের সাথে নদীর সম্পর্ক অভিন্ন; প্রাচীণকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক মানুষের জীবন জীবিকার সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের জীবন যাপন, কৃষ্টি কালচার, সামাজিক রীতিনীতি গড়ে উঠেছে নদীগুলোকে কেন্দ্র করে। নদীগুলোকে কেন্দ্র করে যুগযুগ ধরে চলমান রয়েছে সভ্যতা। আবার নদীগুলোর দখল, দুষণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, আইন নিয়ম তোয়াক্কা করে মনের মাধুরি মিশিয়ে খেয়ালখুশি মতো নদীগুলোকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে সেই যুগযুগ ধরে সভ্যতা ধ্বংস করছি আমরাই। কি চমৎকার তাই না? যে নদীগুলোর দ্বারাই সভ্যতার সৃষ্টি আবার সেই নদীগুলোই ধ্বংস করে সভ্যতা বিলিন করছি।
নতুন প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয় নদী কি? নদীগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য, নদী দিয়ে আমাদের সভ্যতার কতটুকু অবদান রয়েছে? এমন প্রশ্ন করার সাথে সাথে হয়তো অধিকাংশ তরুণদের মুখ মলিন হয়ে যাবে এবং সুযোগ বুঝেই গুগলে সার্চ দেয়া শুরু করবে। অথচ এই তরুণরাই বেশিরভাগ সময় তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সময় ব্যয় করে। বেশিরভাগ সময় তথ্য প্রযুক্তির দিকে ব্যয় করলেও দেশের নদী নিয়ে তাদের কোন ধারণা, জানার আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা নদীর সভ্যতা নিয়ে জানার বা ভাবার আগ্রহ নেই বললেই চলে। যদি নতুন প্রজন্ম তথা তরুণদের বলা হয় নদী আমাদের জন্য কি কি উপকারে আসে? এমন প্রশ্নের উত্তরে হতবাক চাহনী ছাড়া কিছুই নেই তাদের কাছে। প্রশ্ন আসে আসলে এই সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে অথবা রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা কে রাখবে? কাদের রাখার কথা? সংবিধান, আইন বিধি কাদের উপরে দায়িত্ব বর্তায়ে দিয়েছে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে প্রশ্ন যাই থাকুক, যেভাবেই থাকুক, যার উপরেই থাকুক নদী রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা বা কাজ না করলে সভ্যতা হাড়িয়ে যাবে।
১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস বা আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। সারা বিশ্বে বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। নদীর প্রতি আমাদের করণীয়, নদী রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব, কতটুকু দায়বদ্ধতা তা উপলব্ধি ও স্মরণ করিয়ে দিতেই এমন দিবস পালনের সূচনা। দিবসটি উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও নানা কর্মসূচি পালন করে। ১৯৯৭ সালের ব্রাজিলে কুরিতিবা শহরে এক সমাবেশ থেকে নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতে এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, নদীমাতৃক দেশে এখনো সরকারিভাবে এ দিবসটি পালনের উদ্যোগ দেঠা যায়নি। কি ভাবছেন? ভাবতে তো হবেই… সরকারে যারা থাকেন তারাই সরকারের ছত্রছায়ায় থেকেই নদীগুলো দখল করছেন। এমন কথার সাথে হয়তো অধিকাংশই একমত হবেন। অব্যাহত দখল, অবকাঠামো ও দূষণে ধ্বংসের মুখে সারা দেশের নদনদী-জলাশয়। জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ আইন-১৯৯৭ ও হাইকোর্টের সব রায় মেনে সব নদীর সীমানা নির্ধারণ কতটুকু হয়েছে। নদী রক্ষা না হলে দেশ রক্ষা হবে না। নদী রক্ষার জন্য নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা আন্তরিক থেকেও নির্বাহী ক্ষমতার অভাবে খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না। আমাদের প্রয়োজন নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তিশালী নদী কমিশন। তবে আমাদের উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে। অতএব, এই সত্তার ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করাও সরকারসহ আমাদের সবার দায়িত্ব।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা আজ ব্যাপকভাবে নদী বিপর্যয়ের শিকার। অধিকাংশ নদীই নাব্য হারিয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ মূলত গঙ্গা-বহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর পলি মাটি দিয়ে গঠিত একটি বদ্বীপভূমি। একাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। নদীগুলো ছিল প্রশস্ত। নদীর গভীরতা ছিল। বর্ষাকালে এসব নদী থাকত প্রমত্তা। এখন সে অবস্থা নেই। সারা বছর নাব্য থাকে এমন নদীর সংখ্যা এখন সর্বসাকুল্যে ২৩০টি। নদীকৃত্য নয়, যেন নদীর শেষকৃত্যের আয়োজন করা হয়েছে। নদী রক্ষার জন্য অনেক আইন আছে। তবে সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় না। নানা কারণে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের অনেক নদী। একাদশ শতাব্দীতে দেশে প্রায় দেড় হাজার নদী ছিল। হারিয়ে যেতে যেতে ষাটের দশকে সেই নদীর সংখ্যা ৭৫০-এ এসে দাঁড়ায়। আর এখন প্রবহমান নদীর এ সংখ্যা কমে হয়েছে ২৩০। গত ৫০ বছরেই হারিয়ে গেছে দেশের ৫২০টি নদী। বাকি নদীও এক এক করে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নদী দূষণ ও অবৈধ দখলদারি থেকে ৪৮ নদী রক্ষা’ প্রকল্পের আওতায় সমীক্ষা চালিয়ে নদী দখলকারী ৩৮ হাজার ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। দখলদারদের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে মুছে ফেলা হয়। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ওই প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে দখলদারদের নাম বাদ দেয় কমিশন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প শেষ হলেও দখলদারদের তালিকা প্রকাশ না করায় প্রকল্পের পুরো টাকা গচ্চা গেছে। ২০২২ সালে সারা দেশে নদী দূষণকারীদের তালিকা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু সবশেষ সেই তালিকার বাস্তবায়ন কতদুর তা কেউ জানে না। ধীরে ধীরে নদী দখল হচ্ছে। নদীর তীর দখল ও ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে কারখানা গড়ে উঠছে। নদীতে প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে নদীর অবস্থান ধরে জরিপ করায় নদী সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
নদীবিষয়ক সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) ২০২২ সালে দেশের ৫৬টি নদীর ওপর জরিপ করে এক-তৃতীয়াংশ নদীতে অতিমাত্রায় দূষণ খুঁজে পায়। শুষ্ক মৌসুমে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৫৬টি নদীর মধ্যে ২৫টিরই ৫ মিলিগ্রামেরও কম পাওয়া গেছে, যা মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা, টঙ্গী খাল, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাড়িধোয়া, সিলেটের সুতাং এবং বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতিলিটারে ১ মিলিগ্রামেরও কম পাওয়া গেছে, আর ঢাকা বিভাগের বালু ও তুরাগ নদীতে এর পরিমাণ ২ মিলিগ্রামের কম। বরিশাল বিভাগের ভোলা খালসহ পাঁচ নদী রামনাবাদ, আন্ধারমানিক, খাপরা ভাঙ্গ ও বলেশ্বর নদী মারাত্মক প্লাস্টিক দূষণের শিকার। ৫৬টি নদীর মধ্যে ১৬টি গৃহবর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের শিকার। অন্যদিকে ৩৫টি নদী প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য এবং পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে দূষিত হয়েছে। রংপুরের কেবল তিনটি নদী ছাড়া দেশের সব বিভাগের নদীই শিল্পকারখানার দূষণের শিকার। ২০১৬ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল দেশের অন্তত ২৯টি নদী চরম নদী দূষণের শিকার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ২২টি কৃষি পণ্য উৎপাদনে বিশ্বে ১০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই সফলতার পেছনেও রয়েছে নদীর অবদান। কিন্তু মানুষ তার নিজের স¦ার্থে নদীগুলো ধ্বংস করে ফেলছে। এর ফলে শুধু যে নদীগুলোর অস্তিত্ব হারিয়েছে তা নয় মানবজাতিকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
জাতীয় নদী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘দেশে নদী রক্ষার অনেক আইন আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। নদী কমিশনকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।’ ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল সম্প্রতি মিডিয়ায় বলেন, ‘নদী যারা ধ্বংস করেছে বা করছে, তাদের যদি আপনি শাস্তি দিতে না পারেন, একটাও যদি আপনার উদাহরণ না থাকে, তাহলে আপনি কীভাবে নদী রক্ষা করবেন? পৃথিবীর যে জায়গায় আইন একেবারেই বাস্তবায়ন হয় না, সেটা আপনি কীভাবে আশা করবেন? সরকারি কোনো কর্মকর্তা তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব না পালন করার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমরা কি দেখেছি যে, একজন দূষণকারীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?’ এ দুজনের কথায় এটাই স্পষ্ট যে, আইন আছে বাস্তবায়ন নেই, আইন অনুযায়ী শাস্তি নেই এবং যাদের প্রতি দায়িত্ব তাদের দায়িত্বহীনতা রয়েছে।
এখন নদী রক্ষায় দায়িত্ব কে নিবে? যার উপর দায়িত্ব তারা নিবে না, যাদের উপর দায়িত্ব নেই তারা নিবে। যাদের উপর আইনগতভাবে দায়িত্ব বর্তায়ে দেয়া হয়েছে তারাই দায়িত্ব পালন করছে না আর যাদের উপর দায়িত্ব নেই তারা কিভাবে দায়িত্ব পালন করে? এমন প্রশ্ন আশাটাই স্বাভাবিক। তবে আমি বলবো কিছু কিছু দায়িত্ব আছে যা দায়িত্বভার দেয়ার প্রয়োজন হয়না। সে রকম একটি দায়িত্ব হলো নদী রক্ষা। নদী রক্ষা করতে হবে আমার জন্য, আমাদের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য। নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাঁচবে দেশ ও পরিবেশ। এ জন্য আগে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে, নিজেদের পরিবেশ রক্ষা, জীবন-জীবিকার জন্যও নদীগুলো রক্ষা করতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে আসতে হবে, স্থানীয় পর্যায় সামাজিক সংগঠন তৈরী করে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী হয়ে কাজ করতে হবে, স্থানীয় পর্যায় নদী রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদী রক্ষায় বেশি বেশি প্রকল্প গ্রহণসহ বাস্তবায়ন করতে হবে। নদী দুষণ দখলকারীরা যতই প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর হোক না কেন দেশ, মানবজাতি, পরিবেশ রক্ষাসহ মানবসভ্যতা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী রক্ষা কমিশনসহ নদী রক্ষায় দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের নির্মোহ থাকতে হবে এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে, জাতীয় পর্যায় নদী রক্ষা কমিটি গঠন করা দরকার। উপজেলা পর্যায় নদী রক্ষা কমিটি করতে হবে, যে কমিটি শুধু নদী রক্ষায়ই কাজ করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন এর মতো তৃণমুল পর্যায় একাধিক সামাজিক সংগঠন রয়েছে তাদের সমন¦য় হতে পারে উপজেলা, জেলা নদী রক্ষা কমিটি এবং কেন্দ্রীয় পর্যায় ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর মতো সংগঠনের সমন্বয় কেন্দ্রীয় নদী রক্ষা কমিটি থাকতে পারে। নদী রক্ষা কমিটি গঠণ এখন সময়ের দাবি।
পরিশেষে বলতে চাই, অব্যাহত দখল, অবকাঠামো ও দূষণে ধ্বংসের মুখে সারা দেশের নদনদী-জলাশয়। আজ দেশের নদীগুলো মরে গেছে, এখন শেষ কৃত্যের পালা। নদীগুলোর শেষ কৃত্য করতে চাই না। আগেই বলেছি, নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবেন না, ঠিক নদীর শেষ কৃত্য হলে মানুষসহ মানব সভ্যতা বাঁচবে না। আসুন আমরা মানবসভ্যতা বাঁচাতে নদীকে বাঁচাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এএসজি