Tuesday 22 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপির কর্মী ও সমন্বয়ক পরিচয়ে যুবলীগ নেতার মামলা বাণিজ্য!

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:১২

মো. দেলোয়ার হোসাইন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: কখনো আওয়ামী লীগ নেতা, কখনো বিএনপি নেতা, কখনোবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক। এরকম নানা পরিচয়ে পরিচিত তিনি। নাম তার মো. দেলোয়ার হোসাইন। বাণিজ্যে তার জুড়ি নেই। দলীয় পরিচয়ে বাণিজ্য করেছেন গত ১৫ বছর। তারপর বাণিজ্য করেছেন সমন্বয়ক পরিচয়ে। নিজেই মামলা দেন, আবার নিজেই অর্থের বিনিময়ে মামলার আসামি থেকে বাদ দেন। এখন বাণিজ্যের চেষ্টা করছেন বিএনপি পরিচয়ে। অথচ গত ১৫ বছর সবাই জানতো তাকে যুবলীগ নেতা হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই দেলোয়ার দীর্ঘদিন থেকে সম্পৃক্ত রয়েছেন এসি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং মার্চেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন ব্রামার সিন্ডিকেটের সঙ্গে। নানা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্রামার সাবেক সভাপতি মো. আসাদুজ্জামানের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত দেলোয়ার। গত স্বৈরাচার সরকারের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও মোহাম্মাদপুর থানা আওয়ামী লীগের নেতা আসাদকে তিনি নিজের নেতা হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া মনে করে গর্ব করেন। দেলোয়ারের সঙ্গে এক ব্যক্তির ফোনালাপের রেকর্ড এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে।

বিজ্ঞাপন

ব্রামার সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে দেলোয়ার ওই ব্যক্তিকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আসাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়। ফিল্মে দেখেন না ওইরকম বড় মাপের সন্ত্রাসী। তার সাথে খেলায় আপনারা পারবেন না।’

অভিযোগ রয়েছে, গত সরকারের আমলে যুবলীগ নেতা পরিচয়ে দাপিয়ে বেরিয়েছেন দেলোয়ার। তার পিতা কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী শ্রমিক লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জে হলেও থাকতেন সাভারে। সাভারে থেকে ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যুবলীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দেন। ওই সময় তিনি আহতও হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অবস্থান পালটিয়ে মিশে যান স্রোতের সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী আহত আন্দোলনকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দেলোয়ার। সেইসঙ্গে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তিনি।

দেলোয়ারের প্রতিবেশী জসিম উদ্দিন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘২৪-এর ছাত্র আন্দোলনের পর শুনছি দেলোয়ার আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেলোয়ার ও তার বাবা শুরু থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাভারে থাকা অবস্থায় ছাত্রদের দমন করতে গিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে মাঠে ছিলেন। আন্দোলন দমন করতে গিয়েই আহত হন দেলোয়ার। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন মানুষের নামে মিথ্যা মামলা দিচ্ছেন। আবার মামলা থেকে নাম বাদ দিতে চাঁদা দাবি করছেন।’

জসিমের এমন অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে দেলোয়ার যাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন এবং সেখান থেকে নাম বাদ দিতে যাদের কাছে অর্থ দাবি করেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এদের একজন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আবুল কাশেম। একটি বাণিজ্যিক সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে নির্বাচিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেন দেলোয়ার। আবুল কাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি কক্সবাজার ছিলাম। এর সকল তথ্যপ্রমাণ আমার কাছে আছে। দেলোয়ার আমাকে হয়রানির জন্য মামলা দেয়। এর পর আমার সঙ্গে দেখা করে নিজেকে ছাত্র-সমন্বয়ক দাবি করে বলেছে, পাঁচ লাখ টাকা দিলে মামলাটি মিটমাট হয়ে যাবে।’

সাভারের আরেক ব্যবসায়ীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে তার কাছ থেকে দেলোয়ার মোটা অংকের টাকা আদায় করেছেন বলেও জানান আবুল কাশেম। অন্য একটি কল রেকর্ডে এক ব্যবসায়ীকে মামলার আসামি থেকে নাম বাদ দিতে খরচের টাকা চান দেলোয়ার। কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা ও রিফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশন ব্যবসায়ী সংগঠনের কিশোরগঞ্জ জেলা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি নাসির উদ্দীন শাহিনকে হুমকি দেন দেলোয়ার। সেই ভয়েজ রেকর্ডও এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।

ওই অডিওতেও দেলোয়ার নাসিরকে বলছিলেন, ‘আপনি অডিও দিয়ে আবার ডিলেট করলেন কেন। বিএনপির তারেক রহমান কি আপনাকে এসব শিখিয়ে দিছে? বিএনপিতে আপনাকে পদ দিছে কেডা? এতদিন আপনাকে ওস্তাদ ওস্তাদ বলে তেল দিছি। এবার আপনার বদমাইশি ছাড়াচ্ছি।’

দেলোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন সময়ে জবরদখল, প্রতারণা থেকে শুরু করে চুরি, ডাকাতির মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন এই দেলোয়ার। তার বাবা আব্দুর রহমান ছিলেন ট্রাকচালক। ২০০৭-২০০৮ সালে কিশোরগঞ্জে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী মো. আলী রিপনের দোকানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু দেলোয়ারের। পরবর্তী সময়ে ফ্যান, মোটর মেরামতের কাজ শিখেন তিনি। তার বাবার বিদেশ যাত্রা এবং কিছু আর্থিক স্থিতি অর্জনের পর সে কিশোরগঞ্জ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে গাজীপুর দিয়ে ঢাকামুখো হয় দেলোয়ার। এর মধ্যে এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন দেলোয়ারের বাবা।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী শ্রমিক লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক ও যশোদল ইউনিয়ন আওয়ামী শ্রমিক লীগের সভাপতির ছেলে এই দেলোয়ার এখন নিজেকে বিএনপি কর্মী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে ব্রামার সিন্ডিকেটের হোতা আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে তার। রাতারাতি বর্ণচোরা এই দেলোয়ার এখন বিএনপি পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে। মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। রাতরাতি কালো টাকার মালিক হতে এসির অবৈধ ব্যবসায় আসাদ সিন্ডিকেটকে সহযোগিতা করছে। আসাদের হয়ে প্রতিবাদকারী ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে দেলোয়ার। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতি ও চোরাই মালামাল সংগ্রহের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।

এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমি কোনো অন্যায় করিনি।’ এর পর মামলা থেকে নাম বাদ দিতে চাঁদা চাওয়ার ভয়েজ রেকর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

দেলোয়ার হোসেন বিএনপি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মামলা বাণিজ্য যুবলীগ নেতা সমন্বয়ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর