পুলিশ বলছে চুরি, পিএসসির দাবি ‘নাশকতার অংশ’!
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:১২
ঢাকা: কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশ সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। যদিও সেই অগ্নিকাণ্ডে কোনো নাশকতার আলমত পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার রাষ্ট্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) বড়ধরনের নাশকতার শিকার হতে যাচ্ছিল বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি পিএসসির গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবল লাইন কাটার ঘটনা ঘটেছে। যদিও এ ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে আল আমিন নামে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নাশকতার কোনো মামলা দেয়নি। তকে শ্রেফ একটি চুরির মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এমনকি চুরির মামলার জব্দ তালিকাতেও কোনো আলামত দেখানো হয়নি। অথচ তার কাছ থেকে একটি দামি মোটরসাইকেল, একটি প্লাস ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
হেলমেট ও তামার তার চুরির উদ্দেশ্যে পিএসসির গ্যারেজে প্রবেশ করেছিল আল আমিন- পুলিশ এমন দাবি করলেও পিএসসির দাবি, এটি কোনো চুরির ঘটনা হতে পারে না। এটি নাশকতার অংশ। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু ঘটনার ১০ দিন পরও তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় নড়ে-চড়ে বসেছে পিএসসি। এরই মধ্যে ডেকে আনা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে। সেইসঙ্গে গঠন করা হয়েছে একটি তদন্ত কমিটি।
ইলেকট্রেশিয়ানরা বলছেন, কোনো ভবনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের আর্থিং না থাকলে সেখানে দ্রুত শর্টসার্কিট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আর্থিং লাইন থাকলে শর্ট সার্কিট এড়ানো সম্ভব। সম্ভবত গ্রেফতার আল-আমিনের বিষয়টি জানা আছে। অথবা কেউ তাকে শিখিয়ে দিয়ে থাকতে পারে যে, পিএসসিতে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগের আর্থিং কেটে দিলে বড়ধরনের কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা থাকবে। বিশেষ করে পিএসসির সবধরনের ক্যাবল তার গ্যারেজের ছাদ বরাবর বিশেষভাবে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সদস্য ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিএসসি একটি কেপিআইভুক্ত এলাকা। এখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার করে ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন। এরপরেও একজন ব্যক্তি গ্যারেজের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। এর পর তাকে এমন জায়গায় দেখা যায়, যেখানে সবধরনের ক্যাবল সন্নিবেশিত ছিল। তখন তাকে সেখান থেকে নামিয়ে আনা হয়। ওই ব্যক্তিকে পরে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। আর পুলিশ তার বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলা নথিভুক্ত করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি শুধুমাত্র চুরি মানতে আমি নারাজ। কেননা ওই লোক কোনো সাধারণ পোশাকে আসেননি। তার পরনে পোলো শার্ট এবং জিন্স পরা। এ ছাড়া, তিনি একটি দামি মোটরসাইকেলে করে এসেছেন এই গ্যারেজে। হয়তো এর আগেও তিনি এসেছেন। কেননা একদিনেই কেউ সরাসরি গ্যারেজে প্রবেশ করবে এমন সাহস নেই। ওই ঘটনার পর পিএসসিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কারণ, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তদন্তাধীন রয়েছে। এ ছাড়া, রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি এখানে রয়েছে।’
এদিকে সেদিনের ঘটনার পর সবকিছু আর্কাইভ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আর্কাইভের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘ওই ঘটনায় পুলিশ ছাড়াও পিএসসির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারণ, শুধু পুলিশের তদন্তের ওপর নির্ভর করছি না আমরা। তদন্তে নিশ্চয়ই আসল কারণ বের হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটাকে আমরা সাধারণ কোনো ঘটনা মনে করছি না। যে কারণে নিজস্ব তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চোর কেন মই বেয়ে উপরে উঠবে? তার হাতে প্লাস কেন থাকবে? প্লাস দিয়ে তিনি দু’টি ক্যাবলও কেটে দিয়েছে। এর পর সিকিউরিটি সদস্যরা তাকে নামিয়ে আনে। সচিবালয়ে আগুনের পর পিএসসিতে এরকম ঘটনা নাশকতামূলক ষড়যন্ত্রের অংশ কি না তাই খতিয়ে দেখছি আমরা।’
কেপিআই এলাকার ভেতরে একজন ঢুকে পড়ার পর তাকে চুরির মামলা দিলেন কেন? জানতে চাইলে ড. সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘দেখুন আমরা ওই ব্যক্তিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছি। বাকিটা পুলিশ করেছে। এর বাইরে আমরাও তদন্ত করছি। পুলিশ কেন নাশকতার মামলা না দিয়ে চুরির মামলা দিয়েছে তা জানি না। বিষয়টা গুরুতর তাই গভীরভাবে তদন্তের জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এটা নিয়ে কাজ করছে।’
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম আজম বুধবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিএসসি থেকে ফোন পেয়ে আমি নিজে টিম নিয়ে যাই। এর পর একজনকে নিয়ে আসি। তার বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলা হয়। রিমান্ড শুনানির পর আজ তাকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের কথা ছিল।’
অভিযুক্তের দাবি, সে চুরি করতে প্রবেশ করেছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে ডিএমপিতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ডিএমপি অ্যাক্টে একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় সে জেলেও গিয়েছিল। এর বাইরে রাজবাড়ির পাংশা উপজেলায় তার গ্রামের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে, সেখানে আল আমিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তার বাবা একজন রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। আল আমিন গ্রামে খুব একটা যান না। পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। রাজধানীর পূর্ব শেওড়া পাড়ার ইব্রাহিমপুরে ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন।
শেরেবাংলা থানার ওসির বক্তব্যে চুরির ঘটনায় কেবল কাটার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস, গ্যারেজে প্রবেশ করার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও তার মোবাইল ফোন উদ্ধারের কথা বলা হলেও মামলার এফআইআর-এ তা উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘সবকিছু জব্দ তালিকায় ব্যবহার করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চুরির মামলা হয়েছে। একটি মোটরসাইকেল, একটি মোবাইল ও একটি প্লাস উদ্ধার করা হয়েছে।’ কিন্তু এফআইআর ও এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জব্দ তালিকায় উদ্ধার হওয়া মালামালের কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্যারেজের ছাদের নিচ দিয়ে ইস্পাতের মইয়ের ওপর এসি, টেলিফোন ও ইলেক্ট্রিক তারগুলোর সংযোগ টানা আছে। ঘটনার দিন অভিযুক্ত আল আমিন সেই মইয়ের ওপর ওঠে এবং সেখানে থাকা আর্থিংয়ের তারটি প্লাস দিয়ে অর্ধেক কেটে ফেলে। আরও একটি ইলেক্ট্রিক ক্যাবলে প্লাস লাগানো হলেও সেটি কাটা পড়েনি। তার আগেই লোকজন চলে আসে ও তাকে নামিয়ে আনে। এরপর আনসার সদস্যরা তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আল আমিন যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও যুবলীগ নেতা সাবেক এমপি এস এম জাহিদের সঙ্গে সরাসরি রাজনীতি করতেন। আগারগাঁও এলাকা তথা পিএসসির আশপাশেই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী লীগের পতন হলে যুবলীগ নেতা নিখিল ও জাহিদ গা ঢাকা দেয়। ফলে আগারগাঁও এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তদবির বন্ধ হয়ে যায়। এতে আল আমিনসহ আরও অনেকে এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়ে। অনেকের ধারণা, পিএসসিতে কোনো ধরণের নাশকতা করতে পারলে চলমান অনেক তদন্ত থেমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি।
এদিকে পুলিশের তদন্তের পাশাপাশি পিএসসির নিজস্ব তদন্ত কমিটি ঘটনাটি তদন্ত করছে। এরই মধ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদের পিএসসির পক্ষ থেকে ডেকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থাটির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেপিআই এলাকায় এভাবে কেউ চুরি করে ঢুকতে পারবে না। যে ঢুকেছিল সে হীন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই ঢুকেছিল। পুলিশের কাজ ছিল বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করা। কিন্তু এতবড় একটি ঘটনা পুলিশ খুব হালকাভাবেই নিয়েছে। আলামত জব্দ করা হয়নি। আসামিকে রিমান্ডে আনা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে প্লাস দিয়ে বিদ্যুতের আর্থিংয়ের ক্যাবল কেটেছে, সেটা এখনো জব্দ করা হয়নি। আসামির বাড়ি রাজবাড়ির পাংশা উপজেলায়। ওই একই উপজেলায় ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তারও বাড়ি। এখানে গাফিলতি রয়েছে বলেই ধারণাই করা হচ্ছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম