Thursday 11 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অধরা হয়ে উঠছে সোনা

এমদাদুল হক তুহিন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২৪ ২২:৩১

ঢাকা: দেশের ইতিহাসে সোনার দাম এখন সর্বোচ্চ। সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরি সোনার দাম পৌঁছে গেছে এক লাখ ১২ হাজার ৯০৮ টাকায়। অথচ মাত্র দুই বছর আগেও ২০২২ সালের ৮ মার্চ সোনার ভরি ছিল ৭৯ হাজার ৩১৫ টাকা। আর কয়েক বছর আগে এই দামে কেনা যেত দুই ভরি সোনা।

ব্যবসায়ীদের ধারণা, দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে গত কয়েক বছরে দেশে সোনার বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ক্রেতারাও বলছেন, দেশে প্রতিনিয়ত সোনার দাম বাড়তে থাকায় তারা ভোগ কমিয়েছেন। এমনকি নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের বিয়েতেও এখন সোনার ব্যবহার নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। এ পরিস্থিতিতে ক্রমেই সোনা অধরা হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষের কাছে, সোনার ব্যবহারও কমবে বলে ধারণা সাধারণ মানুষসহ সোনা ব্যবসায়ীদের।

বিজ্ঞাপন

সবশেষ বুধবার (৬ মার্চ) সোনার দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) থেকে ২২ ক্যারেট তথা সবচেয়ে ভালো মানের সোনার দাম ভরিতে পড়বে এক লাখ ১২ হাজার ৯০৮ টাকা, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২১ ক্যারেটের সোনার দাম ভরিপ্রতি এক লাখ সাত হাজার ৭৭৫ টাকা। ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ৯২ হাজার ৩৭৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরির নতুন দাম ৭৬ হাজার ৯৮২ টাকা। এর আগে সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি সোনার দাম পুনরায় নির্ধারণ করেছিল বাজুস। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশে সোনার দাম সমন্বয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে সোনার দাম এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্ববাজারে বুধবার (৬ মার্চ) রাত সাড়ে ১০টার দিকে সোনার দাম ছিল আউন্সপ্রতি দুই হাজার ১৪৭ ডলার। গোল্ড প্রাইস নামে একটি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গত ৩০ দিনে সোনার দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ছয় মাসে বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যবধানে সোনার দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। পাঁচ বছরে সোনার দাম বৃদ্ধির হার ৬৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

দেখা গেছে, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি সোনার দাম ছিল আউন্সপ্রতি এক হাজার ৯১৫ ডলার। ২০২২ সালের নভেম্বরে সোনার দাম ছিল এক হাজার ৬০০ ডলারের কিছু বেশি। আর ওই বছরের মার্চে সোনার দাম উঠেছিল দুই হাজার ডলারের বেশি। সব মিলিয়ে এখন সোনার দাম বাড়তি রয়েছে বিশ্ববাজারে।

বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেড়েছে বলেই আমাদের সমন্বয় করতে হয়েছে। না হলে সোনা অন্য দেশে পাচার হয়ে যাবে। পৃথিবীর সব দেশকেই সোনার দাম সমন্বয় করতে হয়, এর বিকল্প নেই। এটি তদারকির জন্যও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন সোনায় বিনিয়োগ করে বেশি লাভ পাচ্ছে। এ কারণে সোনার দাম বাড়ছে। বিশ্ব বাজারে বিনিয়োগের জন্য সোনার চাহিদাও বেড়েছে। করোনার পর থেকেই সোনার দাম বাড়ছে। করোনা মহামারি আগে সোনার ভরি ৭০ হাজার টাকার নিচে ছিল। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও সোনার চাহিদা বেড়েছে।’

বিনিয়োগে সোনার চাহিদা বাড়লেও সাধারণ ক্রেতারা চাহিদা কমিয়েছেন— এ বিষয়ে সাধারণ ক্রেতাদের বক্তব্য প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সোনার দাম বাড়ায় দেশে ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে। আগে মানুষ পাঁচ ভরি সোনা কিনে থাকলে সেখানে তা কমে আসছে। আগে এক লাখ টাকায় যারা দুই ভরি সোনা কিনতেন, এখন হয়তো এক ভরি দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। গত এক বছরে আমাদের বিক্রি ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে।’

বাজুসের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ভ্যাট ট্যাক্স ও ট্যারিফ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতার ওপর চাপ বাড়ছে। সোনার দাম দিন দিন বাড়ছেই, কমছে না। বিয়েতে এখন মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী সোনার গহনা দিতে পারছে না। এখন এক ভরি সোনা কিনতেই এক লাখ ১৫ হাজার টাকা মতো চলে যাবে। পাঁচ শতাংশ ভ্যাট দিলে সেটি আরও বেড়ে যায়। ক্রেতাদের সোনার প্রতি যে আকর্ষণ ও প্রয়োজন ছিল— তা এখন কমে গেছে।’

জেনারেল জুয়েলার্সের এই কর্ণধার বলেন, ‘আগে পাঁচ ভরি সোনার যে দাম ছিল, এখন সেই টাকা দিয়ে হয়তো তিন ভরি সোনা কেনা যাচ্ছে। এর প্রভাবে গত পাঁচ বছরে সোনার বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। সোনার পরিমাণ ও অর্থ— দুই দিক থেকেই বিক্রি কমেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুয়েলারি ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু সেই তুলনায় বিক্রি ও মুনাফা কম। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করছি, এখন অন্য ব্যবসায় যাওয়ার সুযোগও নেই। মুনাফা কমে যাওয়ায় অনেক ছোট ছোট জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মাজেদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোনার দাম আন্তর্জাতিক মূল্যের ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। সোনার দাম বাড়ছে এবং বেড়েই চলছে। আমাদের দেশে সোনার দাম বেশি থাকার কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম— সোনা আমদানিতে আমদানি শুল্ক রয়েছে। ডলার ও সোনা দুটির দামই বেড়ে চলছে। সোনার দাম বেড়ে গেলে সেটি রিজার্ভের ওপর প্রভাব ফেলবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভে যে সোনা থাকে, দাম বাড়ার কারণে রিজার্ভও বেড়ে গেছে বলে মনে হবে। কিন্তু সোনার দাম বাড়ার কারণেই কিন্তু রিজার্ভ বেড়েছে, সোনার মজুত বাড়েনি। রিজার্ভের সেই হিসাব দেখে অর্থনৈতিক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে তা সঠিক হবে না। বরং সেটি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় এই খাতে অর্থ প্রবাহ (মানি ফ্লো) কমে যাবে। জিডিপিতে প্রভাব পড়বে। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা কমবে, যে কারণে সোনাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমও কমে আসবে।’

অর্থনীতিবিদ ও ইকোনমিক রিসার্চ ফ্রন্টের ফাইন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ড. সায়েম আমীর ফয়সল সারাবাংলাকে বলেন, ‘টাকার মূল্য কমলেই সোনার দাম তত বাড়বে। এর মানে হচ্ছে মানুষ টাকা ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম দুই হাজার ১৩৮ ডলার। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এই দাম ছিল এক হাজার ৮৩২ ডলার। বিশ্ববাজারেই এখন সোনার দাম বাড়তি, যার প্রভাব দেশে পড়তেও বাধ্য।’

এদিকে সোনার দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তারা সোনার ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। আগে বিয়ে বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে একা না পারলেও পরিবারের দুই-তিনজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব দুই-তিনজন মিলে সোনার গহনা উপহার দিতেন। এখন সেই হারও অনেক কমে এসেছে।

কর্মজীবী তরুণী ঝিনুক মালা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিনই অফিসে আসা-যাওয়া করতে হয়। তাই নিরাপত্তার কারণে সোনার গহনা ব্যবহার করি না। তাছাড়া আগে ছোট সোনার গয়না কেনা যেত। কিন্তু যে হারে দাম বেড়েছে, এখন সোনা কেনা বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। সোনার ভরি যদি লাখ টাকার ওপরে হয়, তাহলে সোনা না কিনে অন্য কিছুতে সেই অর্থ বিনিয়োগ করা সম্ভবত বেশি লাভজনক।’

মধ্যবয়সী শিরিন আখতার বলেন, ‘বিয়েতে এখন আর আগের মতো সোনা দেওয়া যায় না। আগে বিয়ের অনুষ্ঠানে অল্প পরিমাণে হলেও সোনার গহনা দেওয়া হতো। এখন ছেলে-মেয়েদের বিয়েতে সোনা গহনার ব্যবহার অনেকটা কমেছে। দাম এভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে তা অধরা হয়ে উঠবে।’

কথা হলে আঁখি নামের একজন নারী বলেন, ‘আগের মতো এখন আর সোনার গহনা কিনতে পারছি না। আগে টাকা জমিয়ে কোনো না কোনো গহনা কিনে রাখতাম। এখন কেনা যাচ্ছে না। কারণ ছোট কোনো গহনা কিনতে গেলেও তো লাখ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে।’

রিপা নামের আরেক নারী বলেন, ‘ভবিষ্যতের সঞ্চয়সহ নানা কারণেই আগে সোনার গহনা কিনে রাখার চেষ্টা করতাম। চেষ্টা করতাম একটু কষ্ট করে হলেও ভারী ওজনের গহনা কেনার। এখন অল্প ওজনের গহনা কেনাও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/এনএস/টিআর
বিজ্ঞাপন

৯ দিনের ব্যবধানে বাড়ল সোনার দাম
১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৫৪

৭ পুলিশ সুপারকে বদলি
১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৫৩

আরো

এমদাদুল হক তুহিন - আরো পড়ুন