ঢাকা: শরিফ ওসমান হাদি। বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ। উচ্চকিত কণ্ঠ, আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের মহিমা তাকে এমন এক চরিত্রে পরিণত করেছিল যে, তিনি মানুষের আশা–বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি ঘাতকের গুলিতে শহিদ হওয়ার পর এখন বিস্ময়করভাবে প্রজন্মের প্রতিরোধ চেতনারও প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি।
গত ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার। সকাল থেকে নির্বাচনি প্রচারে ছিলেন সেগুনবাগিচা ও মতিঝিল এলাকায়। দুপুরে জুম্মার নামাজের পর তার যাওয়ার কথা ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কর্মীদের সান্নিধ্যে, দুপুরের খাবার খেতে। কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হলো না তার। পথেই বিজয় নগরের কালভার্ট রোড এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে অবশেষে হার মানলেন তিনি।
গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল (১৮ ডিসেম্বর) না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। আজ (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তার মরদেহ দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি ফিরছেন প্রাণহীন। কিন্তু ইতিহাসকে নির্মাণ করেই ফিরছেন জুলাই আন্দোলনের এই অকুতোভয় সৈনিক।
শহিদ ওসমান হাদির দেহ দেশে প্রত্যাবর্তন ও জানা সম্পর্কে তার হাতে গড়া সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ গণমাধ্যমে জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট আগামীকাল স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে শহিদ ওসমান হাদিকে নিয়ে রওনা করবে। ঢাকায় অবতরণের সম্ভাব্য সময় ৬টা ৫মিনিট।
ইনকিলাব মঞ্চ আরও জানায়, শহিদ ওসমান হাদির প্রথম জানাজা সিঙ্গাপুরের ‘দ্য আঙ্গুলিয়া’ মসজিদে সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে। আর বাংলাদেশে শহিদ ওসমান হাদির জানাজা, শনিবার বাদ জোহর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে শরিফ ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংস্থা। এমনকি আগামী শনিবার (২০ ডিসেম্বর) হাদির মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোকও ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওসমান হাদি। তিনি নির্বাচনি মাঠে ছিলেন নতুন, কিন্তু জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল। আর সেই বৃদ্ধিটাই তার জন্য কাল হলো। এমনই কাল হলো যে, তার জীবন ও পরিবারের সামনে কেবলই অন্ধকার।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপ যখন দেশের প্রতিটি শহর–মফস্বলে ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক সেই সময়ই নামটি বেশি উচ্চারিত হতে থাকে—শরিফ ওসমান হাদি। উত্তপ্ত রামপুরা, মালিবাগ, বিজয়নগর; রাজধানীর ধুলা ও ধোঁয়ার রাস্তায় তাকে প্রায়ই দেখা যেত। সামনে থাকা তরুণদের উদ্দেশে উঁচু গলায় ঘোষণা দিছ্নে—‘ভয় পাবেন না, আমরা ন্যায়বিচার চাই। সেই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরব না।’
ঘরে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যার পাশে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু হাদি রাজপথ বেছে নিয়েছিলেন। আন্দোলনের অগ্নিঝরা রাতে তিনি ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে টেনে নিয়েছেন আরেকদিনের স্লোগান। তার চোখের সামনে ঘটেছে সহিংসতা, ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, গ্রেফতার আর নিখোঁজের মর্মান্তিক দৃশ্য। তবুও তিনি পিছু হটেননি।
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন মাদরাসার শিক্ষক ও ইমাম। একজন সৎ, মমতাবান, সত্যনিষ্ঠ মানুষ। হাদি বলতেন, তার ‘সত্য বলার সাহস’ বাবার কাছ থেকেই শেখা। স্কুল জীবনেই লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক, পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কারও। পরে নেছারাবাদ কামিল মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
কিন্তু মাদরাসার ছাত্র হওয়ায় তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল নানা পক্ষপাত, তকমা, অপমান আর রাজনৈতিক নির্যাতনে ভরা। বারবার ‘শিবির’ বা ‘হেফাজত’ তকমা নিয়ে তাকে হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল। হয়তো তাই তার ভেতরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস তৈরি হয়েছিল গভীরভাবে।
শরিফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক যাত্রা লম্বা নয়, মাত্র কয়েক বছরের। কিন্তু ব্যক্তিত্ব, প্রতিবাদী অবস্থান ও জনস্বার্থে নির্ভীক ভূমিকার কারণে তিনি এমন এক নাম হয়ে উঠেছিলেন। তার মতামত ও মনোনীত কর্মসূচিগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও তথাকথিত অধিকারের ভিত্তিতে একটি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের আগেই ঘাতকের বুলেটের আঘাতে প্রাণ গেল তার।
হাদির গল্পটা শুধু রাজনীতির নয়, এটা এক তরুণের সাহস, স্বপ্ন, বিশ্বাস ও ত্যাগের গল্প। যে তরুণ প্রাণহীন ফিরছেন কফিনে। এখন তার দরজায় অপেক্ষা করছে একটি পরিবার, আর রাজপথে লাখো মানুষ।