Thursday 18 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমকামীদের মধ্যে বাড়ছে এইডস, শনাক্তের বাইরের রোগীরা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:০৬ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৩৮

প্রতীকী ছবি। এইচআইভি-এইডস

ঢাকা: দেশে সমকামীদের মধ্যে বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ তথ্য হলো, শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীরা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শনাক্তের বাইরে থাকা এইডস আক্রান্তদের দ্রুত পরীক্ষা করে চিহ্নিত করতে না পারলে এই রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় এইডস-এসটিডি কর্মসূচি সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশে সমকামী নারী-পুরুষের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের হার বেড়েছে। এইডস আক্রান্তদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ সমকামী। এছাড়া ২৭ শতাংশের বেশি এখনো শনাক্তের বাইরে রয়েছেন। এদের মাধ্যম সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, দেশে এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের শনাক্ত, তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও এ সংক্রমণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস-এসটিডি কর্মসূচি। সরকারের চতুর্থ হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রামের (এইচএনপিএসপি) আওতায় এ কর্মসূচি চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস-এসটিডি কর্মসূচির তথ্য বলছে, দেশে এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩ জন। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৯৮৪ জন। এখনো শনাক্তের বাইরে রয়েছে ৪ হাজার ১৫৯ জন। শনাক্তের বাইরে থাকা বিপুল সংখ্যক এইচআইভি আক্রান্তের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি।

এইডস-এসটিডি কর্মসূচির তথ্যমতে, দেশে এই ভাইরাসের আক্রান্তদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পুরুষ, ২৪ শতাংশ নারী ও এবং ১ শতাংশ হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার। এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত তাদের মধ্যে সবচেয়ে হচ্ছে সমকামী। এই সংখ্যা আক্রান্তদের ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে সাধারণ মানুষ ২৭ শতাংশ, প্রবাসী ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারী ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ, রোহিঙ্গা শরণার্থী ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ, ট্রান্সজেন্ডার ১ দশমিক ৩০ শতাংশ ও নারী যৌনকর্মী শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহারুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমকামীদের মধ্যে এইডসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে হলে এইডস কীভাবে ছড়ায় তার নিয়ে প্রচার-প্রচারণা ও কাউন্সেলিং জরুরি।’

অধ্যাপক মোজাহারুল আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বিতীয় ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি ৯৫-৯৫-৯৫ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এ স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এইচআইভিতে আক্রান্তদের শতকরা ৯৫ জনকে শনাক্ত করতে হবে। শনাক্তকৃতদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসাধীন ৯৫ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু দেশে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এটি অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি যত্নবান হয়ে কাজ করতে হবে।’

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যারা শনাক্ত হয় তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে ১৩টি কেন্দ্রে। এছাড়া, এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস-এসটিডি কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে সেভ দ্যা চিলড্রেন, আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআর ও ঢাকা বাংলাদেশ কাজ করছে। তারা এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের খুঁজে বের করা, পরীক্ষার আওতায় আনা, ঝুঁকি হ্রাসে কনডম বিতরণসহ অন্যান্য কাজগুলো করে থাকে। আক্রান্তদের চিকিৎসার ওষুধসহ যাবতীয় কাজে মাসে ১০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদের শেষপর্যায়ে অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ায় এইচআইভি-এইডস কর্মসূচি কাজে কিছুটা ধীরগতি নেমে এসেছে।

এইডস-এসটিডি কর্মসূচির সিনিয়র ম্যানেজার মো. আক্তারুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, বিশ্বের প্রায় ৩৯ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশে আক্রান্ত আনুমানিক সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩ জন। এখন পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৯৮৪ জন শনাক্ত হয়েছে। যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের ৭৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় এসেছে।

তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বিতীয় ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি ৯৫-৯৫-৯৫ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এ স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এইচআইভিতে আক্রান্তদের শতকরা ৯৫ জনকে শনাক্ত করতে হবে। শনাক্তকৃতদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসাধীন ৯৫ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু দেশে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।’

আক্তারুজ্জামান জানান, এইচআইভিতে আক্রান্ত ৯৫ জনের মধ্যে ৭৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তকৃতদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, এইডস শনাক্তে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, দেশের প্রতিটি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ না থাকা।

যেভাবে সংক্রমণ ছড়ায়

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানবদেহে বিভিন্নভাবে এইডস রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা বীর্য বা জরায়ু রসের সঙ্গে যদি সুস্থ কোনো ব্যক্তির রক্ত, শরীর রস বা মিউকাস আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তবে এইচআইভি তথা এইডস রোগের বিস্তার ঘটে। এসব সংস্পর্শ নানাভাবে ঘটতে পারে, যেমন- অবাধ যৌনাচার, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা দাঁতের চিকিৎসা বা অপারেশনসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার।

সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশকিছু পদক্ষেপ নিলে এইচআইভির সংক্রমণ থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে। যেমন- অবাধ যৌনাচার বন্ধ করা, কনডমের ব্যবহার নিশ্চিত করা, রক্ত সংগ্রহের আগে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা, গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কিনা তা পরীক্ষা করা, সুচ-সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা। সর্বোপরি এইডস থেকে নিজেকে ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে হলে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম