ঢাকা: দেশের ব্যাংক খাতের সংকটের প্রকৃত চিত্র উদঘাটনে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. লুৎফে সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মের ফলে বর্তমানে ৩৫ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। অনেক খেলাপি প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. সিদ্দিকী বলেন, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট কোনো একক কারণে সৃষ্টি হয়নি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও স্থানীয় বাস্তবতা মিলেই আজকের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে কোনো ‘সিলভার বুলেট’ নেই। দরকার বহু দিক থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ। ব্যাংকের পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলার বিষয়টি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবারের সদস্য হন, বাস্তবে কীভাবে তা সামাল দিতে হবে, এখনই সে প্রেক্ষাপট বোঝার সময়।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এখন সাধারণ মানুষের জন্যও বিপজ্জনক। ৩৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক সংকট, পরবর্তী সময়ে সুদহার পরিবর্তন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক মডেল আর আগের মতো কাজ করছে না; ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও নতুন বাস্তবতায় খাপ খাওয়াতে হবে।
ব্যাংকিং পুনর্গঠনে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে তিনি দেখেন—ডিপোজিটের বৃদ্ধি সঠিক বিনিয়োগে পরিণত না হওয়া। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ঋণ খেলাপিদের পুনর্বহাল করা হয়, যা গভর্ন্যান্স সংকটকে আরও বাড়ায়।
তার মতে, আচরণগত ও শৃঙ্খলাগত উন্নয়নের জন্য মনোবিজ্ঞানী, আচরণ বিশেষজ্ঞসহ পেশাদার প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা প্রয়োজন। এজন্যই তিনি খেলাপি ঋণ ও আর্থিক অপরাধের কৌশল বিশ্লেষণে একটি ট্রুথ কমিশন জরুরি বলে মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আখতার হোসেন বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, দুর্বল তদারকি ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের চাপ মিলিয়ে ব্যাংক খাত এমন ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছেছে, যা এড়িয়ে গেলে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি হবে। সময় দিলেই সংকট কাটবে না—এখনই সাহসী কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, মূলধন ঘাটতি এবং বড় খেলাপিদের প্রতি নরম মনোভাব সংকট গভীর করেছে। সংস্কারমূলক কঠোর পদক্ষেপ নিলে স্বল্পমেয়াদে চাপ বাড়বে, কিন্তু স্থিতিশীলতার জন্য তা অপরিহার্য। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে মুদ্রানীতি পরিচালনা এবং মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জনগণের আস্থা কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণাও কার্যকর হচ্ছে না। কঠোর মুদ্রানীতি ও ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা—এই দ্বৈত সংকেত পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে দিন দিন।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরিফিন বলেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে পতনের দিকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়, কারণ উদীয়মান অর্থনীতিতে একটি ব্যাংকের ধ্বসই পুরো ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করতে পারে। ব্যাংক সংকটের মূল দুটি কারণ—পর্ষদের অনিয়ম এবং ক্রয়ে অস্বচ্ছতা। অনেক পরিচালক ঋণ দেওয়ার সময় ভেন্ডরের মতো আচরণ করেন।
পিআরআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, বহু বছরের অনিয়ম, উচ্চ খেলাপি ঋণ, দুর্বল ঋণ পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় ব্যাংক খাত আজ ভঙ্গুর। দ্রুত ও কঠোর সংস্কার ছাড়া উত্তরণের পথ নেই। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে উল্লেখ করে একটি দক্ষ ও সচেতন পেশাদার গোষ্ঠী তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তিনি জানান, ব্যাংক ধসের মূল কারণ ইনসোলভেন্সি ও লিকুইডিটি সংকট। উচ্চ এনপিএল, দুর্বল প্রভিশন, এভারগ্রিনিং, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ধস, ঋণ পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতা—এসব মিলিয়ে অনেক ব্যাংক দেউলিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার আমানতকারীদের আস্থা কমে গেলে তারল্য সংকট দেখা দেয়; ২০২৪ সালের আগস্টে এর স্পষ্ট চিত্র দেখা গেছে।