Thursday 11 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘থানা থেকে লুট করা বন্দুক নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৩৪ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৩৬

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শোকরানা। ছবি: সংগৃহীত

বগুড়া: বগুড়ার ফোর স্টার হোটেল নাজ গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. শোকরানা বলেছেন, ‘দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতি শুরু করি। সেই সময় থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। ছাত্র অবস্থায় দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন বগুড়ার কৃতি সন্তান শহিদ রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্সের সদস্যগণ পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সংবাদের ভিত্তিতে আমিসহ আমার পাঁচটি টিম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। জিয়াউর রহমানের কথা বলে আমার সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উৎসহ যোগাই।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সময়ে কয়েকটি টুটুবোর রাইফেল এবং বগুড়া সদর থানায় থাকা গাদা বন্দুক লুট করে পাক আর্মিদের সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। সেসময় পাক আর্মিরা বগুড়া মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। আমরা শহরের কাটনারপাড়া কটন মেইল এলাকায় গ্লাস ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন জায়গায় থেকে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করি। এই গুলিবর্ষন প্রায় এক মাসের মত চলতে থাকে। পরে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।’

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে হোটেল নাজ গার্ডেনে সারাবাংলা ডটনেট-এ সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সারাবাংলা ডটনেট-এর বিশেষ প্রতিনিধি বগুড়া।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শোকরানা বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫০ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা-মৃত-আব্দুস সামাদ ও মাতা মৃত-মোছা. হেমায়াতেুন নেছা। তারা চার ভাই ও তিন বোন। এদের মধ্যে শোকরানা তৃতীয় ভাই। বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর ডেপুটি স্টাফ অফিসার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের পহেলা রমজান ইফতারের পর বগুড়ার বাঘোপাড়া নামক স্থানে মিটিং করে ফেরার সময় সেখান তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে জাসদ। এসময় শোকরানার দলে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আনোয়ার রানা মারা যান। আর শোকরানার বড় ভাই আব্দুস সালাম বুলবুলকে জাসদের লোকজন অপহরণ করে নিয়ে যায়। আজও তার কোনো সন্ধান মেলেনি। পরবর্তীতে তারা শোকরানার পরিবারকে জানায় যে তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। কথাগুলো বলার সময় শোকরানা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

একান্ত সাক্ষাতকারে মুক্তিযোদ্ধা শোকরানা বলেন, ‘চারিদিকে যুদ্ধের ডামাডোল। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের জেড বিমান দিয়ে আকাশপথে মহড়া দেওয়া শুরু করে বগুড়ায়। একসময় পাক আর্মিরা এই জেলার ভেতরে প্রবেশ করে। প্রবেশ করে প্রথমে পাকিন্তান আমলের সাবেক মন্ত্রী ফজলুল বারীকে হত্যা করা হয়। তখনই আমরা ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। এরপর সাবেক এমপি মোজাফ্ফর হোসেন ও মোস্তাফিজার রহমান পোটলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতে চলে যাই। সেখানে কামারপাড়া ক্যাম্পে পাবনার অধ্যাপক আবু সাঈদ ইনচার্জ ছিলেন। পরে আমাকে সেখানে প্রশাসনিক কর্তকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামারপাড়া ক্যাম্পে লোকাল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি প্রশাসনিক বিয়য়ও দেখতে হয়েছে। সেখানে একজন সুবেদার মেজর ছিলেন। টিক্কা খান বলে তাকে আমরা ডাকতাম। কিছুদিন চলার পরে আমাদের উচ্চ ট্রেনিংয়ের জন্য কামারপাড়া ক্যাম্পের মাঠে সমাবেত করে। সেখান থেকে বাছাই করে আমাকে ও আমার প্রয়াত বড় ভাই আব্দুস সালাম বুলবুলকে নেয়া হয়। পরবর্তীতে জানতে পারি আমাদেরকে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের দেরাদুন নামে পাহাড়িয়া অঞ্চলে নেওয়া হবে। পরে আমাদের শিলিগুড়ি বিমান ঘাটিতে হয়ে দিল্লির দেরাদুন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কমান্ডার ছিলেন জেনারেল ওবার্ট। তার অধীনে ভারতের আর্মিদেরও ট্রেনিং হচ্ছিল। ৪৫দিনের ট্রেনিং ছিল। সেখানে ৪০ দিনের মাথায় আমাদের ৫ জনকে বাছাই করা হয়। তাদের মধ্যে আমি একজন। একটা টপ সিক্রেট মিশনে আমাদের দেরাদুন থেকে শিলিগুড়ি পানিঘাটা নামে একটা ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি স্বাভাবিকভাবে ৪০ দিনের ট্রেনিং গ্রহন করি।’

শোকরানা বলেন, ‘মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে আমরা ৫ জন ছিলাম। এরপর আমাকে ৭নং সেক্টরের সঙ্গে এ্যাটাচমেন্ট করে দেওয়া হয়। ৫টি মুক্তিযোদ্ধার টিম আমার অধীনে ছিল। তারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘চাপাইনবাবগঞ্জে মার্শাল মনি কোন কোন এলাকায় আমি যুদ্ধ করবো সে বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে আমি দেশের ভেতরে এসে প্রথমে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার গনকপাড়া গ্রামে যাই। সেখানে আমার মা অবস্থান করছিলেন। ফজরের আযানের সময় ওই গ্রামে অবস্থান নেই। অবস্থান নেয়ার সময় আমাদের গ্রামের লোকজন গানবোর্ড নিয়ে পাক আর্মি ও কিছু দালাল রাজাকারসহ আমাদের উপর আক্রমন চালায়। সম্মুখ যুদ্ধ চলে তাদের সঙ্গে। দিন-রাত যুদ্ধ চলে। পরে পাক আর্মিরা বাই ওয়ারলেসে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে পাকিন্তান এয়ার ফোর্স আকাশে জেড বিমানের মহড়া চালিয়ে ধীরে ধীরে সেখান থেকে তারা সারিয়াকান্দি শহরে চলে যায়। এরপর সেই জায়গা আমরা আর নিরাপদ মনে করিনি। আমার মা-ও সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যান। পরবর্তীতে বগুড়া শহরের পশ্চিমে এরুরিয়া এলাকায় অবস্থান নেই। সরকারি আজিজুল হক কলেজ, পশু হাসপাতালসহ অন্যান্য স্থানে পাক আর্মিদের অবস্থান ছিল। এসব জায়গায় আমরা রাতে তাদের উপর আক্রমন করতে থাকি। এরপর ডিসেম্বরে ভারতের সামরিক বাহিনী (মিত্র বাহিনী) যুদ্ধ করতে করতে বগুড়ার ভেতরে প্রবেশ করেন। ওইসময় আমরাও প্রবেশ করি। একপর্যায়ে পাক আর্মিরা গ্রেফতার হয়। সেময় আমার কাছে ৮ জন পাক আর্মি গ্রেফতার ছিল। তখন জানতে পারি পাক আর্মিদের ভারতীয় সামরিক বাহিনী নিচ্ছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেস্বর ওই ৮ জনকে বগুড়া সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর পরেই সারা বাংলাদেশে বিজয়ের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে।’ সারাবাংলা ডটনেট থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শোকরানাকে ধন্যবাদ জানালে তিনিও সারাবাংলা ডটনেটকে ধন্যবাদ জানান।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর