ঢাকা: রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে বড় বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে মরিয়া ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো ব্যাংক একক গ্রাহককে নিজস্ব ঋণসীমার অধিক ঋণ দিয়েছে। এভাবে ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত মোট ঋণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে ঋণ প্রাপ্তিতে তলানিতে রয়েছে অবশিষ্ট বাকি ৬ বিভাগের গ্রাহকেরা। সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ হয়েছে সিলেট বিভাগে, মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঋণের পাহাড় গড়ে উঠেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি শিল্প গ্রুপের ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেডের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের বিপরীতে জামানতকৃত সম্পত্তির ঘাটতি প্রায় ৭৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এসব বড় ঋণগ্রহীতাদের প্রায় সবাই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহক। প্রসঙ্গত: দেশের শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে ১৯ জনই ঢাকা ও চট্টগ্রামের কোনো না কোনো ব্যাংকের গ্রাহক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভাগওয়ারি হিসাবে চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর শেষে ঢাকা বিভাগ ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। সেপ্টেম্বর শেষে চট্টগ্রাম বিভাগে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
একই সময়ে খুলনা বিভাগে বিতরণকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ।
রাজশাহী বিভাগে বিতরণকৃত ঋণ ৬৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বরিশাল বিভাগে ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা বা ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
রংপুর বিভাগে ব্যাংকগুলেরা ঋণের পরিমাণ ৩৯ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ২৭ শতাংশ।
ময়মনসিংহ বিভাগে ঋণ ২১ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
একই সময়ে তলানিতে থাকা সিলেট বিভাগে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে জানান, বড় ব্যবসায়ীদের প্রকল্প ঋণ পাস করলে বোর্ডের সদস্য থেকে শাখা কর্মকর্তারা কমিশন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া, কখনো কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও ঋণ অনুমোদনে তদবির করে থাকেন। আর বড়দের ঋণ দিলে বড় সুবিধা, সেজন্য ছোটদের ঋণ পেতে সমস্যা।
ব্যাংক ঋণ বিতরণে বিভাগওয়ারি বিশাল ব্যবধানের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের সুযোগ-সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ হিস্যামত পান না। এতে বড় গ্রাহক ছাড়া অন্যদের বিভিন্ন এনজিও কিংবা মহাজনের দ্বারস্থ হতে হয়। চড়া সুদের জালে প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তারা ঘুরপাক খাচ্ছেন। তারা বড়দের তুলনায় ঋণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ঋণ দিয়েছে। বড় গ্রাহকরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কখনও জামানত ছাড়া বা নামমাত্র জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। অথচ একজন ছোট গ্রাহক ঋণের জন্য গেলে ব্যাংকগুলো অজুহাত দেখায়, ঋণ দিতে চায় না। অথচ পল্লী ও কৃষি ঋণের এবং এসএমই ঋণের আদায় সন্তোষজনক। কিন্তু তাদের সামান্য কটা টাকা খেলাপি হলে কারাগারে যেতে হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি অঙ্কের ঋণগুলোকে বৃহৎ ঋণ বিবেচনা করা হয়। গত মার্চ পর্যন্ত এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, তখন মোট ১৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা মোট ঋণের বড় ঋণ ছিল প্রায় ১০ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা বা ৬২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই বড় ঋণের ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংক খাতে শীর্ষ ৫০ জন গ্রাহকের অনুকূলে ছিল। যা শতকরা হিসাবে ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। আবার বড় ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ব্যাংক ঋণের একক গ্রাহক সীমার নিয়মে একজন গ্রাহককে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। আবার ব্যাংকগুলো নতুন শাখা ও উপশাখা চালু করতে পল্লী অঞ্চলের সমসখ্যক শাখা খোলার বাধ্যবাধকতা মানতে হয়। এসব নিয়মিত তদারকি করা হয়। তবু বিগত সময়ে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় ব্যাংক খাতে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে এর উত্তরণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’