বগুড়া: রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা প্রশাসনিক অনিয়ম ও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষায়িত এই ব্যাংকটিতে গত অর্থ বছরে ১৩২ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওয়াহিদা বেগমের অদক্ষ্যতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে। পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দিয়ে নিজের খেয়াল খুশিমতো ব্যাংক চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের পুনর্বাসন করে নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। এতে ব্যাংকজুড়ে চরম অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাড়ছে বিভেদ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা। এই ঘটনায় এমডিকে কৈফিয়ত তলব করেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।
জানা যায়, ২০২৫ সালের ৯ মার্চ রাকাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পান আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ওয়াহিদা বেগম। যোগদানের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও রাকাবের উন্নয়নে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি তিনি। উলটো দায়িত্ব নেওয়ার পর চেয়ারম্যান-পরিচালকদের পাশ কাটিয়ে খেয়াল খুশিমতো ব্যাংক চালাতে থাকেন। তার এই কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ পরিচালনা পর্ষদ। গত ৩ ও ১২ নভেম্বর দুই দফা এমডিকে কৈফিয়ত তলব করেছেন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আলী। কিন্তু চেয়ারম্যানের সেই কৈফিয়তের জবাব দেননি এমডি ওয়াহিদা বেগম।
অভিযোগ উঠেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ আউট সোর্সিং কোম্পানির সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ৭২১ জন নিরাপত্তা প্রহরী ও অফিস সহায়কদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ও কমিশনের ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই কর্মকর্তা।
রাকাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আউট সোর্সিং কোম্পানির সঙ্গে জনবল সরবরাহের চুক্তিটি ২০২৩ সালে ১৬ এপ্রিল ৫৬১তম সভায় নবায়ন করে পরিচালনা পর্ষদ। চলতি বছরের ৩১ জুলাই সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আউট সোর্সিং কোম্পানি নিয়োগ করার কথা। কিন্তু তা না করে এমডি বিধি-বহির্ভূতভাবে এই খাতে প্রায় ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন। সর্বশেষ পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গত ২০ নভেম্বর তিনি সীমিত টেন্ডারের উদ্দেশ্যে তালিকাভুক্তির নোটিশ জারি করেন। এই ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্ত এমডি বাস্তবায়ন করছেন না বলে অভিযোগ করেছেন খোদ চেয়ারম্যান।
অভিযোগ রয়েছে, এমডি ব্যাংকের স্পর্শকাতর ও অতিগুরুত্বপূর্ণ ডাটা সেন্টারের টেন্ডার সংক্রান্ত যাবতীয় বিল আটকে দিয়েছেন। এই ঘটনায় চরম ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকের সার্বিক নিরাপত্তা। এনিয়ে বারবার সতর্ক করার পরও তা আমলে নিচ্ছেন না এমডি। এছাড়া মিথ্যা ভাউচার দেখিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
চেয়ারম্যানের অভিযোগ, এমডির এই আচরণ চরম রহস্যজনক। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তিনি বৈধ বিল পরিশোধে কালক্ষেপণ করছেন। এদিকে চলতি বছরের মে মাসে চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে প্যানেল আইনজীবীদের। নতুন করে আইনজীবী নিয়োগ না দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ আইনজীবী প্যানেল দিয়েই কোর্টে ব্যাংকের মামলা চালাচ্ছেন এমডি। দিচ্ছেন মামলা পরিচালনার বিলও। যা পুরোপুরি বেআইনি ও অবৈধ বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান। এতে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন চেয়ারম্যান। কিন্তু তা কানে তুলছেন না এমডি।
এমডির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, চলতি বছরের জুনভিত্তিক পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন তিনি। এতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দ্রুতই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান। কিন্তু তা আমলে নেননি এমডি। উলটো চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে ২০ জনকে প্রধান কার্যালয় থেকে রংপুর বিভাগে বদলি করেন। এমডির একতরফা ও অযৌক্তিক এই সিদ্ধান্তে ব্যাংকজুড়ে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচার ও খুনি সরকারের আমলে যারা রাকাবে জুলুম-নির্যাতন ও বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতা করেন এমডি। তাদের প্রধান কার্যালয়ে সংগঠিত করার অভিযোগ এনেছেন চেয়ারম্যান। দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের পদ বাঁচাতে উচ্চপদস্থ কতিপয় কর্মকর্তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত আবাসন সুবিধা দেন। আটকে দেন ইসলামি ব্যাংকিং বাস্তবায়ন। এমডির পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নীতি ভেঙে দুই দিনের পরিবর্তে সাপ্তাহিক ছুটি ৩ দিন ভোগ করছেন।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)-এর এমডি ওয়াহিদা বেগম বলেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান স্যার একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছেন। আমি সব চিঠিরই জবাব তাকে দিয়েছি। পাশাপাশি সব টেন্ডারও দেওয়া হয়েছে। আমি এটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো সঠিক নয়। এখানে যোগদানের পর আগে যা পেয়েছি আমি সেই হিসাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’