Thursday 11 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লোনা জলের জীবন
জরায়ু সমস্যা বাড়ছে উপকূলীয় নারীদের

মৃত্যুঞ্জয় রায় অপূর্ব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০৩

সমুদ্র উপকুলে লোনাজলের জীবন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

সাতক্ষীরা: উপকূল মানেই নোনাপানির সঙ্গে বসবাস। সেইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভাঙন, বন্যা, ভূমিকম্পতো লেগেই আছে। সবকিছু মিলিয়েই প্রতিনিয়ত সংগ্রামে বাঁচে উপকূলের মানুষগুলো। এদের মধ্যে কারও বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, কারও স্বপ্নের চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারও যাচ্ছে প্রাণ, কেউ হারাচ্ছেন স্বপ্ন। কেউ কেউ আবার শহুরে কাজের সন্ধানে বাসস্থান ছাড়ছে। জীবন বাস্তবতায় স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে শিশুগুলো। এই বয়সেই ঢুকে যাচ্ছে কাজে, বাড়ছে শিশুশ্রম। এতে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের শৈশব, দিক হারাচ্ছে কৈশোর। আবার নোনজলের কারণে নারীদের জরায়ু সমস্যা নতুন করে সামনে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে তাদের চুল ও ত্বকের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া গর্ভপাত এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য নদীর লবণাক্ত পানিতে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা সময় কাটায়। ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন এসব নারী ও শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতী নারীরা উচ্চ রক্তচাপ, ডেলিভারি সম্পর্কিত জটিলতা, অকাল প্রসব ও জন্মগত সমস্যা মোকাবিলা করছেন।

লবণাক্ত পানির কারণে নারীদের জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগ বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের। তাদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততা প্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি দেখা যায়।

লবণাক্ততার প্রভাবে শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে ফের সেটি ব্যবহার করে। এছাড়া, তারা লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজ করে। এ কারণে জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

ক্যানসারবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবোকনের ২০২০ সালের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলা হয়, ক্যানসার আক্রান্ত ৬৮ হাজার ৭০০ নারীর মধ্যে ১৯ শতাংশ স্তন ক্যানসারে, ১২ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যানসারে, ১১ দশমিক ১ শতাংশ খাদ্যনালীর ক্যানসারে, ৭ দশমিক ৮ শতাংশ পিত্তাশয়ের ক্যানসারে, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ মুখ ও ঠোঁটের ক্যানসারে এবং ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ নারী কয়েক ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত।

খোলপেটুয়া নদীর পাশে বসবাসকারী স্বামী পরিত্যক্তা বনজীবী নারী রেহানা খাতুন সারাবাংলাকে জানান, উপকূলে জীবিকা নির্বাহের জন্য ৫০ শতাংশ নারীকে নদীতে মাছ ধরাসহ মৎস ঘেরে কাজ করতে হয়। তার স্বামী তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে নদীতে জাল টেনে ও মৎস্য ঘেরে কাজ করে দুই মেয়েকে নিয়ে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছেন। লবণ পানিতে নামলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলার্জি এবং ঘা-পাঁচড়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে হয়। এছাড়াও ঘটে অকাল গর্ভপাতের মতো ঘটনা, সেইসঙ্গে শারীরিক নানা সমস্যা তো হয়-ই।

সাতক্ষীরা শ্যামনগরের গাবুরা এলাকায় গেলে দেখা মেলে রহিমা বেগমের সঙ্গে। লবণ পানিতে নেমে তিনি চিংড়ির পোনা শিকারে জাল ঠেলছেন, আর তার সাত বছর বয়সী ছেলে সেই মাছের পোনা গামলায় রাখছেন। রহিমা বেগমের কাছে জানতে চাইলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভাবের সংসার। আমি জাল না ঠেললে খাওয়া চলে না। তাই এই লবণ জলে জাল ঠেলে জীবিকা নির্বাহ করছি।’

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নদীর লবণাক্তার কারণে নারীদের জরায়ুতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে চর্মরোগ হতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা জানান, ঋতুস্রাবের সময় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। যা লবণাক্ত পানিতে ধোয়ার ফলে প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ হয়। ওখানকার মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বাথরুম ব্যবহার করতে ভয় পায়। উপকূলীয় অঞ্চলে ঋতুস্রাবের সময় নোনাজলে পুরনো কাপড় ধুয়ে ব্যবহার করতে গিয়ে সংক্রমণ ও জরায়ুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকে কিশোরীরা। ফলে অনেকেই মাসিক বন্ধ রাখার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া শুরু করে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাসের পর মাস পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ রাখছে। যা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় সকালে তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি
১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর