পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ের মীরগড়ের নাম উঠলেই প্রথম যে খাবারটি স্মরণে আসে, তা হলো ‘টোপা’। শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা এই রসালো মিষ্টান্ন এখন শুধু স্থানীয়দের পছন্দে সীমাবদ্ধ নয়, বরং হয়ে উঠেছে জেলার গর্ব ও পরিচয়ের অংশ। সুস্বাদু, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদ হওয়ায় টোপার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
স্থানীয় ইতিহাস বলছে, প্রায় শত বছর আগে মীরগড়ের আন্ধারী বেগম নামের এক প্রবীণ নারী প্রথম এ বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরি করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতেন। তিনিই মিষ্টিটির নাম দেন ‘টোপা’। সে সময় প্রতিটি টোপা বিক্রি হতো মাত্র দুই পয়সায়। ধীরে ধীরে এর স্বাদ দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং মীরগড় হয়ে ওঠে টোপার জন্মভূমি।
আগে টোপা বানানো হতো চালের গুঁড়া ও ময়দা দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেসিপিতে কিছু পরিবর্তন আসে, এখন টোপা পুরোপুরি ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয়। লম্বাটে আকৃতির টোপা এখন গোলাকার। ময়দার মণ্ডকে ছোট গোল আকারে গড়ে তেলে ভেজে, পরে চিনি বা গুড়ের শিরায় ডুবিয়েই তৈরি হয় রসালো টোপা।
মীরগড়ে পাওয়া যায় দুই ধরনের টোপা-চিনির শিরায় এবং গুড়ের শিরায়। দর্শনার্থীরা টোপার রসে ডুবে একবার খেলে আবার ফিরে আসেন এই ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে।
আন্ধারীর কাছ থেকে টোপা বানানোর কৌশল শেখেন দুখু মোহাম্মদ নামে এক স্থানীয় অধিবাসী। স্বাধীনতার পর দুখুর মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন তার ছেলে আজিজুল ইসলাম। দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে নিজের দোকানে টোপা বিক্রি করে আসছেন তিনি। বয়সের ভারে আজ আর টোপা বানাতে না পারলেও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তার ছেলে জাহের আলী। প্রতিদিন দুই থেকে তিন শ’ পিস টোপা বিক্রি হচ্ছে তাদের দোকানে। দামও সাশ্রয়ী-একেকটি টোপা ১০ টাকা।
জাহের আলী জানান, ‘এটা আমাদের বাবার-দাদার ব্যবসা। আমরা শুধু ঐতিহ্যই ধরে রাখছি না, লাভও করছি।’
মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ‘মীরগড়ে বেড়াতে এসে টোপা না খেলে যেন ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।’
টোপা এখন পঞ্চগড়ে অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম প্রধান মিষ্টান্ন। স্কুল-কলেজের টিফিনেও শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ এটি। কৃত্রিম রং বা কেমিক্যাল ছাড়া তৈরি হওয়ায় টোপা হয়ে উঠেছে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে সবার আস্থাভাজন।
শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম নাহিদ ও সজিব জানান, ‘টিফিনের পর সবাই মিলে টোপা খাই। খেতে খুব মজা লাগে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘মীরগড়ের রসালো মিষ্টান্ন টোপা স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করেছে।’
স্থানীয়দের মতে, টোপা শুধু একটি মিষ্টি নয়; এটি মীরগড় তথা পঞ্চগড়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এর স্বাদ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মিলিয়ে টোপা এখন পঞ্চগড়ের অন্যতম ব্র্যান্ড।