এই শীতে ঘুরতে যাই চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল… (২য় পর্ব)
২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৬:৫৩ | আপডেট: ২ জানুয়ারি ২০১৮ ১২:০০
হৃদয় দেবনাথ
হাইল-হাওর
শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে বৃহত্তর সিলেটের মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত বিখ্যাত হাইল-হাওর। এই হাওরে শীত মৌসুমে সাতসমুদ্র তেরনদী পার হয়ে বেড়াতে আসে অতিথি পাখিরা। তারা দল বেঁধে হাওরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। হাওরের জলে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, অতিথি পাখিদের জলকেলী, আর পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত পর্যটকদের মনকে ভরিয়ে তুলবে অনাবিল আনন্দে।
রামনগর মনিপুরী পাড়া
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে মনিপুর রাজপুরুষ মোয়রাং থেম গোবিন্দের নেতৃত্বে একদল মনিপুরী মনিপুর রাজ্য ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের খাসগাওয়ের রামনগরে এসে আবাস গড়েন। খাসগাওয়ে রয়েছে মোয়রাং থেম গোবিন্দের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ, যা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। স্বতন্ত্র কৃষ্টি, সভ্যতা, ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণসমৃদ্ধ এক বৈশিষ্ট্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে আপনিও এই পাড়ায় আসতে পারেন। এখানে আপনি মনিপুরী মেয়েদের তাঁতের কাপড় বুননের দৃশ্য দেখতে পাবেন এবং পছন্দ মত শাড়ি, চাদর, ওড়না ইত্যাদি কিনতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালিঘাট চা-বাগানের রাস্তা ধরে দুই কিলোমিটার পথ পেরুলেই আপনি পৌঁছে যাবেন মনিপুরী পাড়ায়।
মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি
মাগুরছড়ায় রয়েছে খাসিয়াপুঞ্জি। উঁচু পাহাড়ের ওপর বিশেষভাবে নির্মিত তাদের আবাস। খাসিয়া সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে এখানে। প্রতিটি পুঞ্জিতে একজন করে মন্ত্রী (খাসিয়াদের হেডম্যান) থাকেন। তার অনুমতি নিয়ে পুঞ্জি এলাকা ঘুরে দেখতে পারেন। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পান গাছের সারি চোখে পড়বে। সারি সারি উঁচু পাহাড়ি গাছগাছালি পরম মমতায় পানের লতাকে বুকে ধারণ করে আছে, যা অন্যরকম এক সৌন্দর্য। খাসিয়াপুঞ্জি ভ্রমণ করে আপনি সহজেই খাসিয়াদের স্বতন্ত্র এবং বিচিত্র জীবনধারা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।
পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসকূপে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নিবিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়াপুঞ্জি, চা বাগান, রেললাইন, সবুজ বনাঞ্চল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই গ্যাসকূপটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরক্ষিত এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। ৭ বছর ধরে এ এলাকাটিতে পুনরায় সজিবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বন বিভাগ। আগুনে পোড়া গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাগুরছড়ায়। শ্রীমঙ্গল থেকে সড়কপথে এখানে আসতে নয়ন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
ডিনস্টন সিমেট্রি
শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রির ইতিহাস মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ডিনস্টন চা বাগানে এর অবস্থান। আজ থেকে শতাধিক বছর আগে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন চা বাগানে ডিনস্টন সিমেট্রির গোড়াপত্তন হয়। ১৮৮০ সালে এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর সুদূর ব্রিটেন থেকে এখানে চা চাষী ও ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটতে থাকে। জাহাজ, ঘোড়ার গাড়ি কিংবা হাঁটার সেই যুগে সেসব বিদেশিদের অনেকেই এই অঞ্চলে মারা যায়। তাদের সমাহিত করা হয় শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে। উঁচু নিচু পাহাড়ঘেরা চিরসবুজ চা বাগানের মাঝে অবস্থিত সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবর রয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে পাঁচটি কবরে কোনো পরিচিতি নেই। এখানে গেলে একই কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত ব্রিটিশ দম্পতি কিংবা নিষ্পাপ শিশুর কবর আমাদের মনকে অদ্ভুত বিষন্নতায় ছুঁয়ে দেয়।
জলপ্রপাত যজ্ঞকুঞ্জের ধারা
শ্রীমঙ্গলের একমাত্র জলপ্রপাত যজ্ঞকুঞ্জের ধারা। এটি জাগছড়া চা বাগান এলাকায় অবস্থিত। জলপ্রপাত দেখতে আপনি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজার রোড হয়ে কাকিয়া নেমে ডান দিকে জাগছড়া চা বাগান চলে যাবেন। অথবা শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়াউড়া চা বাগান হয়ে কাঁচা রাস্তায় জাগছড়া চা বাগানে কাউকে জিজ্ঞেস করে চলে যাবেন জাগছড়ার ১৪ নং সেকশনে। সেখানে চোখে পড়বে একটি ব্রিজ। ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে ছড়ার পাড় ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই শুনতে পাবেন শোঁ শোঁ শব্দ। জনশ্রুতি রয়েছে- শ্রীমঙ্গলের কালাপুরে প্রাচীন বেলতলীতে দেবস্থান নির্মাণ করেন তৎকালীন রাজা। দেবস্থান নির্মাণকালে বিরাট যজ্ঞস্থানকে পরিষ্কার করে যে পয়ঃপ্রণালি সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই জলপ্রপাতের আকার ধারণ করে, যা আজো যজ্ঞধারা বা যজ্ঞছড়া নামে কথিত রয়েছে।
পাহাড় ডোবা লেক
শ্রীমঙ্গলের বন-পাহাড়, হাওর-বিল আর সবুজের সমারোহে একাকার হয়ে গড়ে ওঠা হ্রদটির নাম পাহাড় ডোবা লেক। বিলাসছড়া চা বাগানের পাদদেশে এই জলাশয়ের অবস্থান। প্রচার না হওয়ায় পর্যটক তথা এলাকাবাসীর পদচারণা খুব একটা হয়নি এ জলাশয় এলাকায়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালীঘাট রোড ধরে দলই চা বাগানের রাস্তা ধরে বিলাসছড়া পৌঁছা যায়। বিলাসছড়া অফিস ও লিপ হাউস ছাড়িয়ে কিছু সামনে এগুলেই দেখা যায় লেকটি। এটি চা বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত। সবুজ বন বনানী বেষ্টিত পাহাড় ডুবে পরিণত হয়েছে বিশাল জলরাশিতে। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে জলের পাশ দিয়ে নতুন একটি রাস্তা করা হয়েছে। এলাকাটির প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তবে বিলাসছড়া চা বাগানের সুপারিনটেনডেন্টের অথবা বিটিআরআই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেড়ানো যায় এখানে।
ছবিঃ লেখক
লেখকঃ মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি, জিটিভি
সারাবাংলা/আরএফ