Saturday 22 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরিবেশ বান্ধব নিরাপদ পোশাক পরিধান করি

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
২০ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৩

মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পোশাক বা কাপড়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মার্জিত, সুন্দর ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করে সমাজে চলাফেরা করা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের স্বভাব-প্রকৃতি অনুভব করা যায়। পোশাক মানুষের শালীনতাবোধ, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও সহজাত ভদ্রতার রুপ ফুটিয়ে তোলে। পোশাক নির্বাচন বা পরিধানে যথাযথভাবে গুরুত্ব না দিলে ব্যক্তিত্বকে নেতিবাচকভাবে প্রতিফলিত করে। পোশাক শুধুমাত্র শরীরের আবরণ নয়, এটি আমাদের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। পোশাক আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পোশাক যেমন মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি তৈরী পোশাক দ্বারা যাতে পরিবেশ দূষিত না হয় এবং ব্যবহারকারি যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেবিষয়েও সচেতন থাকা প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

১৯৮০-এর দশকের তুলনায় পোশাকের ব্যবহার বেড়েছে ৫ গুন। ২০০০ সালে উৎপাদিত টেক্সটাইল ফাইবারের পরিমাণ ছিল ৫৮ মিলিয়ন টন, ২০২০ সালে ১০৯ মিলিয়ন টন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১৪০ মিলিয়ন টনে উন্নীত হওয়ার আশা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি, মাথা পিছু বর্ধিত আয় এবং নগরায়ন বৃদ্ধির ফলে পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। পোশাকের এই বর্ধিত চাহিদা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে পরিবেশ বান্ধব কাপড় ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আমার আজকের লেখার মুল উদ্দেশ্য হলো শক্তিশালী পোশাক খাতকে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বান্ধব হিসেবে সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেবিষয়ে আলোকপাত করা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০০ কোটি মিটার কাপড় প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষ প্রতিবছর ৩০–৩৫ মিটার কাপড় ব্যবহার করে থাকেন। এই বিপুল পরিমাণ কাপড়ের চাহিদা পূরণ হয় হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুম এবং বিদ্যুৎচালিত তাঁত বা পাওয়ারলুমের মাধ্যেমে। বাংলাদেশের কাপড়ের বাজারের মোট মূল্য প্রায় ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিটিএমএর তথ্য মতে, দেশে ৮০২টি মিল ওভেন কাপড় এবং ৩২টি মিল ডেনিম কাপড় তৈরি করছে। এছাড়াও হোম টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা ২২। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই রিয়াজ গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিনের প্রচেষ্টায় ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা মূল্যের ১০ হাজার শার্ট ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে বিক্রির মাধ্যমে দেশের প্রথম কাপড় রপ্তানী শুরু হয়।

বাংলাদেশের মেডিকেল টেক্সটাইল শিল্পে কটন সুতার উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে যা দ্রুত সম্প্রসারিত স্বাস্থ্য সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি, বেসরকারি ৭০টি এবং সামরিক মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ০৬টি। সারাদেশের ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে রোগীর বেড সংখ্যা ৭১,৬৬০টি এবং ৫৮১৬টি বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর বেড সংখ্যা ৯৯,৯৭৫টি। দেশের বিপুল সংখ্যক মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও রোগীর চিকিৎসা সেবার জন্য পরিবেশ বান্ধব প্রাকৃতিক গুণাবলীর কারণে তুলা সবচেয়ে উপযুক্ত উপাদান সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপিয়ান সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র Medical Textiles: Significance and future prospect in Bangladesh এ বলা হয়েছে Face Mask, Surgical sutures, Vascular grafts, Medical Mattresses, Artificial ligament, Artificial heart, Artificial Skin, Cervical Collar, Thumb Spica Splint, Elastic Wrist Splint, Lumber corset, Pouch Arm Sling, Anklet, Surgical Suture, Hernia belt ইত্যাদি ১৬ টি মেডিকেল পণ্য সূতি উপাদান থেকে তৈরী হয়। এছাড়াও রোগীদের জন্য সূতি কাপড়ের চাদর, বালিশ ও কভার, মশারি, টাওয়েল, লেপ, গজ, সূতা, সার্জিকাল গাউন, সার্জিকাল মাস্ক, টুপি, ওটি ম্যাক্সি এবং রোগীদের গাউন তৈরী হয়।

তুলা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী, তাই আঘাতের জন্য ব্যান্ডেজ তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তুলার ব্যান্ডেজ ব্যবহার করলে পোড়া রোগীরা আরও ভালোভাবে সেরে উঠতে সক্ষম হন। তুলা ব্যান্ডেজ অন্যান্য উপকরণের তুলনায় রোগীদের জন্য কম অস্বস্তিকর। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী মেডিকেল টেক্সটাইল বাজারের মূল্য ছিল ২৪.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশে একটি মেডিকেল কটন ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে যার মাধ্যমে বেক্সিমকো, স্নোটেক্স, উর্মি গ্রুপ, আমান গ্রুপ এবং ডেক্কো গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু মেডিকেল টেক্সটাইল এবং পিপিই উৎপাদন করে। দেশে উৎপাদিত পণ্যগুলি মেডিকেল টেক্সটাইল চাহিদার মাত্র ২%-৫% মেটায় আর বাকিটা আমদানি নির্ভর। অথচ চীন, ভারত, তাইওয়ান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি পাকিস্তানও মেডিকেল টেক্সটাইল উৎপাদনে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পের ন্যায় মেডিকেল টেক্সটাইল শিল্পেও যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করলে আমাদের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন সহ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।

আদিম মানুষের পোশাক ছিল গাছের ছাল-বাকল এবং পশুর চামড়া। প্রাথমিকভাবে, পোশাক পরার মূল উদ্দেশ্য ছিল শীত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং লজ্জা নিবারণ করা। তবে সময়ের সাথে সাথে পোশাক সামাজিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছদের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠেছে। ‘আই সায়েন্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে, মানুষ বস্ত্র পরিধান করতে শুরু করে প্রায় ১,২০,০০০ বছর আগে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ৩৫ হাজার বছর ধরে মানুষ কাপড় তৈরি করছে। কাপড়ের মূল উপাদান ফাইবার বা তন্তু।ফাইবার প্রধানত দুই ধরনের- ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক এবং আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম। মানুষের শরীর এবং পরিবেশের জন্য আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিমভাবে তৈরী কাপড় অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে, ন্যাচারাল ফাইবার পরিবেশবান্ধব ও শরীর সম্মত। যেকোনো অবস্থায় ন্যাচারাল ফাইবারই সবচেয়ে আরামদায়ক এবং এটিকে প্রকৃতির বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ন্যাচারাল ফাইবার প্রধানত চার শ্রেণীর- সেলুলোজ, রাবার, মিনারেল ও প্রোটিন। প্রোটিন ফাইবার পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রাণী যেমন- ভেড়া, খরগোশ, উট, ভিকুনা ইত্যাদির লোম থেকে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামী, উষ্ণ ও আরামদায়ক কাপড় উৎপাদিত হয় ভিকুনা নামের এক প্রজাতির প্রাণীর পশম থেকে। ভিকুনারা দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার উঁচুতে বাস করে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্যমতে ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি কোটের মূল্য ২১,০০০ ডলারেরও অধিক। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকার সমান। ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি মাফলারের দাম গড়ে ৪,০০০ ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরিকৃত পোশাকের ফিনিশিং এতটাই মসৃণ হয় যে, এর চেয়ে অভিজাত পোশাক আর কোনো উল দ্বারা তৈরি করা সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে ভিকুনা প্রতিপালন করা সম্ভব কি না তা যাচাইয়ে প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। ভিকুনা প্রতিপালন করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ভেড়া গৃহপালিত পশু হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। একটি ভেড়ার শরীরের সাত রঙ এর পশম থাকে। তাই পশম কৃত্রিমভাবে রঙ করতে হয় না। একেবারে রঙিন সুতা পাওয়া যায়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সাদা রঙের ভেড়ার পশমের অনেক চাহিদা রয়েছে। ভেড়ার পশম ধোয়া পানিতে অন্যান্য কাপড় ধোয়া যায়। ভেড়ার পশমে কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ থাকায় ধোয়া পানিতে অন্য কোন কাপড় ধুলে এর জন্য কোন ডিটারজেন প্রয়োজন হয় না। প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে এই পশম থেকে বিভিন্ন প্রকার বস্ত্রসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে ভেড়ার সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার। প্রতিবছর ভেড়া থেকে ৩৪০০ টন পশম উৎপাদন হয়। ভেড়ার পশম থেকে অভিজাত পোশাক তৈরী হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর বিশেষ চাহিদা রয়েছে। ইউরোপ সহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশে ভেড়ার পশমের তৈরি কম্বল, জ্যাকেট ও চাদরের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ভেড়ার পশম, পাট ও তুলা থেকে সুতা তৈরি করা হচ্ছে। যার উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। আমাদের দেশে যে ভেড়া আছে তার পশম থেকে পরিবেশ বান্ধব ৫ লাখ কম্বল তৈরী করা সম্ভব এবং প্রত্যেকটি কম্বলের দাম ২০০০ টাকা হলে এ খাতে আয় হবে ১০০ কোটি টাকা।

চীনের বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস এর রচনা থেকে এবং চীনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে চীনের সম্রাট হুয়াং তাই এর স্ত্রী সম্রাজ্ঞী সাই লিং শি তার বাগানের তুঁত গাছের নিচে বসে চা পান করছিলেন। গাছ থেকে হঠাৎ একটা রেশম পোকার গুটি এসে পড়ে তার গরম চায়ে। যখন কোকুনটি তিনি তুলতে চেষ্টা করেন তখনই ঘটে আসল ঘটনা। সম্রাজ্ঞী অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে, আস্তে আস্তে কোকুনের পাক খুলতে শুরু করেছে এবং তিনি এক সময় অবাক হয়ে দেখেন যে, কোকুন থেকে দ্যুতিময়ী সুতা সদৃশ পদার্থ বেরিয়ে আসছে। এভাবেই সম্রাজ্ঞী লিং শি-এর দ্বারা সিল্কের যাত্রা শুরু। চীনা বণিকেরা প্রায় ৩০টি দেশে তখন ব্যবসা করতে পাড়ি জমালেও একচেটিয়া ও ব্যবসার গোপনীয় রক্ষার্থে কোনো দেশকেই সিল্ক উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পর্কে জানায়নি। রেশম ও সিল্কের গোপনীয়তার স্বার্থে দেশটির সীমান্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষীরা বাণিজ্যে যাওয়া বণিকদের তল্লাশী করে দেখত যেন কেউ রেশমপোকা, রেশমপোকার ডিম বা কোকুন পাচার যাতে করতে না পারে। কিন্তু পরবর্তীতে সিল্কের গোপন রহস্য চীন বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি ফলে বিশ্ববাসী গোপন রহস্য জেনে যায়। বৃটিশ ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, রাজশাহী জেলায় রেশম সুতায় তৈরি রেশম বস্ত্র বুনন বহু শতাব্দি পূর্ব থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু দু:খের বিষয় সিল্ক একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হলেও আমাদের দেশে যেখানে সিল্কের চাহিদা ৪০০ মেট্রিক টনেরও অধিক সেক্ষেত্রে মাত্র ৩৫-৪০ মেট্রিক টন রেশম উৎপাদন হয়। চাহিদার বেশির ভাগই আমদানি করে পূরণ করা হচ্ছে।

সিল্কের তৈরি পোশাকগুলি পাতলা, মসৃণ, নরম, নিঃশ্বাসের উপযোগী, পরতে আরামদায়ক এবং মার্জিত, যা গ্রীষ্মের জন্য আদর্শ কাপড়। সিল্কের প্রোটিনে থাকা ট্রিপটোফ্যান এবং টাইরোসিন অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করতে পারে তাই সিল্কের কাপড় ক্ষতিকর রেডিয়েশন থেকে রক্ষা করে। সিল্কের কাপড় ঘাম এবং শরীরের তাপের দ্রুত অপচয়কে বাধা দেয় যা পোশাক পরিধানকারীকে শীতল অনুভব করতে সাহায্য করে। সিল্কের পোশাক চর্মরোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করতে পারে। সিল্কের প্রোটিন লিউসিন কোষের বিপাক বাড়াতে পারে এবং ক্ষত নিরাময় করতে পারে; সেরিন এবং সুয়ান অ্যাসিড ত্বকের বার্ধক্য প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করতে পারে; গ্লাইসিন সৌর বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে। তাই একজিমা এবং বিভিন্ন চর্মরোগের রোগীরা ক্ষত নিরাময়কে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং সিল্কের অন্তর্বাস পরিবর্তন করে বা সিল্কের কাপড় দিয়ে আক্রান্ত অংশে ব্যান্ডেজ করে অবস্থার উন্নতি করতে পারে।

আমাদের কৃষি অর্থনীতির জন্য দারুণ সুখবর বয়ে আনছে ন্যাচারাল ফাইবার। কৃষির উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আবিষ্কৃত হচ্ছে একের পর এক ন্যাচারাল ফাইবার। পাট হল একটি লম্বা, রুক্ষ, চকচকে বাস্ট ফাইবার যা শক্ত ও মোটা হয়ে থাকে। পাট সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের প্রাকৃতিক ফাইবার গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং তুলার পর বিশ্বে টেক্সটাইল ফাইবার উৎপাদনে পাট দ্বিতীয়। নেচার প্ল্যান্ট জার্নালে ছয় পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ ও ৩৮ পৃষ্ঠার বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তসহ পাট নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট ১০০ প্রজাতির পাটজাতীয় প্রাকৃতিক তন্তুর বৃক্ষ রয়েছে এবং প্রাকৃতিক আঁশের ৮০ শতাংশ আসে পাট থেকে। বিশ্বে উৎপাদিত পাটের আর্থিক মূল্য ২৩০ কোটি ডলার। পাট থেকে তৈরী হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ডেনিম কাপড়। বিশ্বের ডেনিম বাজারে বাংলাদেশের দখল প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ইইউয়ে শীর্ষ ডেনিম রপ্তানিকারক দেশ। এই অঞ্চলে প্রতি তিন জনের একজন বাংলাদেশে উৎপাদিত ডেনিম প্যান্ট পরেন। ২০২২ সালে ইইউয়ে ডেনিম চালান থেকে আয় হয়েছে ১. ৫৬ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রেও ডেনিম রপ্তানি বেড়েছে। দেশে ডেনিম কাপড় উৎপাদনের ৪২টি আধুনিক কারখানা আছে। এ থেকে প্রতি বছর ৯০ কোটি মিটারের বেশি ডেনিম কাপড় উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে প্যান্টের পাশাপাশি ডেনিম কাপড় দিয়ে ছেলে ও মেয়েদের শার্ট ও জ্যাকেট, পাঞ্জাবি, মেয়েদের টপস, শিশুদের পোশাকও তৈরি হচ্ছে। ফ্যাশন সচেতন মানুষের হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, এমনকি পায়ের জুতায়ও জায়গা করে নিয়েছে ডেনিম কাপড়।

পাটের বিকল্প হিসেবে ধইঞ্চা চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক এবং এ গাছ থেকে ন্যাচারাল ফাইবারও তৈরি হচ্ছে। ধইঞ্চা গাছের ন্যাচারাল ফাইবারের রঙ হচ্ছে রুপালি। ধইঞ্চা ফাইবার কিছু অংশে পাটের তুলনায় ভালো। যেমন- ফাইবারের দৈর্ঘ্য, আণবিক বিন্যাস, দৃঢ়তা। স্থায়িত্ব, ঘর্ষণ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ময়লা রোধের ক্ষমতা, পরিচ্ছন্নতা। পাটের জিন গবেষণা ও উন্নয়নে যেমন বিজ্ঞানীরা সাফল্য এনেছেন, তেমনি ধইঞ্চার জিন নিয়ে গবেষণা এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বৈপ্লবিক কিছু ঘটানো সম্ভব।

যখন সুতার ব্যবহার শুরু হয়নি, তখন থেকে লিনেন ন্যাচারাল ফাইবার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। মূলত ফ্ল্যাক্স গাছের আঁশ থেকে লিনেন ফাইবার সংগৃহীত হয়। শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি আরামদায়ক লিনেন। লিনেন ফ্যাব্রিকের বিশেষত্ব হলো এর ‘ক্রিজ’ ও ‘রিংকল’ সৃষ্টি হয় না। শরীরে ঘাম শুষে নিতে পারে সুতির চেয়ে বেশি। আবার শুকিয়েও যায় খুব তাড়াতাড়ি। এ জন্য বিশ্বজুড়ে একে বলা হয় এয়ারকন্ডিশন্ড ফ্যাব্রিক। বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউজগুলোর মধ্যে শতাব্দীই প্রথম লিনেন দিয়ে পোশাক বানাতে শুরু করে, ২০০৩ সাল থেকে।

বাংলাদেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ন্যাচারাল ফাইবার প্রজেক্ট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। কলাগাছের ছাল ও আনারসের পাতা থেকে ন্যাচারাল ফাইবার তৈরি করা হচ্ছে। একটি কলা গাছ থেকে ২০০ গ্রাম সুতা হয়। সেই হিসাবে ৫টি কলা গাছ থেকে ১ কেজি সুতা হয়।কলাগাছের সুতা থেকে হস্তশিল্প তৈরির কাজে ৪০ জনের বেশি নারী কাজ করছে। তার আগে বিভিন্ন পর্যায়ে সাত উপজেলায় ৩০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শাড়ি বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে আরও সময় প্রয়োজন। বিশেষ করে কারিগরি সহায়তা ও কারিগরদের প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে। এগুলো সমন্বয় করা গেলে কারিগররা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে। তখন কলাগাছের সুতা দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প ও শাড়ি মানসম্মত হবে।

তুলা, রেশম, পাট ও কলার গাছ থেকে সুতা বের করে পোশাক বানানোর কৌশল বহু আগেই রপ্ত করেছে মানুষ। হিসপানিকদের আমল থেকে আনারস পাতার তন্তু দিয়েও পোশাক বানানো হতো। এ তন্তুকে বলা হয় পাইনা বা পিনা। আনারসের পাতার আঁশ থেকে এবার বাংলাদেশেও উদ্ভাবন হয়েছে সিল্ক সুতা। এ সুতা থেকে তৈরি করা হচ্ছে আরামদায়ক কাপড়। মানিকগঞ্জ জেলার বেসরকারি সংস্থা আলাপের পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা মাসুদা ইসলাম দীর্ঘদিন নিরলস গবেষণার মাধ্যমে এ সুতা উদ্ভাবন করেন, যার নাম দেয়া হয়েছে পাইনআপল সিল্ক।টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র এলাকা আনারসের জন্য বিখ্যাত। টাঙ্গাইলের মধুপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক হেক্টর জমিতে ৮০০ কেজি ফাইবার হিসেবে বছরে ১৬ হাজার মেট্রিক টন আনারসের ফাইবার তৈরি করা সম্ভব। এ ফলের পাতা থেকে ফাইবার নিয়ে দীর্ঘ একযুগ ধরে কাজ চলছে। সে তন্তু থেকে উদ্ভাবিত কাপড় দিয়ে শাড়ি, শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শাল তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য বিদেশেও রফতানির সুযোগ রয়েছে । এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে ফিলিপাইন। আনারস পাতার ফাইবারের নাম সেখানে ‘পিনা ফ্যাব্রিকস’। ফিলিপাইনে এটি পেয়েছে স্পেশাল ফ্যাশন প্রডাক্টের স্বীকৃতি। শুধু তা-ই নয়, ‘গ্রিন হ্যান্ডিক্রাফট’ লেবেলে সে দেশের পণ্য বিশ্বব্যাপী বাজারজাত হচ্ছে। এতে দেশটি যেমন লাভবান হচ্ছে, তেমনি সেখানকার পরিবেশও রক্ষা পাচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে আর্টিফিশিয়াল ফাইবারের ভয়ংকর ক্ষতির ব্যাপারে সবাই সচেতন হচ্ছে। কেননা, এটা শরীর ও পরিবেশ- দুটোর জন্যই বিপজ্জনক। সেদিক থেকে ন্যাচারাল ফাইবার বা প্রাকৃতিক তন্তুর বিকল্প নেই। ন্যাচারাল ফাইবার নিয়ে আজ পর্যন্ত যত কাজ, সব ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু হয়েছে। ন্যাচারাল ফাইবার এর কাঁচামালও অনেক লাভজনক। কারণ, এটি রপ্তানিযোগ্য। পাটের সুতায় এ দেশে কৃত্রিম আঁশের বিকল্প হিসেবে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি বিদেশের বিখ্যাত সব গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পাট দিয়ে তৈরি করছে গাড়ির অভ্যন্তর। জৈব-ভিত্তিক তন্তুর নবায়নযোগ্য উৎস থাকায় তার পরিবেশগত সুবিধা অনেক।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

পরিবেশ বান্ধব নিরাপদ পোশাক প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর