Monday 24 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে রংপুরের চিত্রপট

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
১ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩২

বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ। নদীর উৎপত্তিগত দিক বিবেচনায় ভৌগোলিকভাবে ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতি। আমাদের উজানে রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশ। আমাদের ভাটিতে নেই কোন দেশ, রয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গোপসাগর। নদীগুলো থেকে পর্যাপ্ত পানি না পেলে ভাটি থেকে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি দেশের মূল ভূখন্ডে প্রবেশ করে জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ তন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। দেশের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর বিভাগের মধ্যে রংপুর অন্যতম। রংপুর বিভাগের কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ক্ষেত্রের লাইফ লাইন তিস্তা নদী। কিন্তু দু:খ বিষয় আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশি রাষ্ট্রের কারণে তিস্তা নিজেই মরণাপন্ন অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিমি। ভারতের সিকিম অংশে তিস্তার দৈর্ঘ্য ১৫১ কিমি, পশ্চিমবঙ্গে ১২৩ কিমি এবং বাংলাদেশের ১২১ কিমি। লাচেন, লাংচু, রোঙ্গিচু, রংপো, রঙ্গিত, লিশ, ঘিশ, চেল, নেওরা ও করলা তিস্তার উল্লেখযোগ্য উপনদী। তিস্তা অববাহিকায় মোট ৩ (তিন) কোটি লোক বাস করে তন্মধ্যে ভারতের সিকিমে ২%, পশ্চিমবঙ্গে ২৭% এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে ৭১% বা ২ কোটি ১৩ লক্ষ লোক বাংলাদেশে বাস করে। বাংলাদেশে বসবাসকারীদের ১ কোটি ৬৬ লক্ষ ১৪ হাজার লোক গ্রামে এবং মাত্র ৪৬ লক্ষ ৮৬ হাজার লোক তিস্তা তীরবর্তী শহরে বাস করে। বাংলাদেশ অংশে তিস্তা অববাহিকায় বসবাসকারী সকল অধিবাসীই কৃষি এবং মৎসের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তিস্তার জন প্রবাহের সাথে তাদের প্রাণ প্রবাহের সম্পর্ক নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। তিস্তা ২৪০ বছরের একটি পুরণো নদী যার প্রবাহ ভারত একতরফাভাবে সেচ কাজের জন্য অন্যত্র সরিয়ে নিতে গজলডোবায় একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। গজলডোবার বাঁধ নির্মিত হয় ২০০৭ সালে এবং এর উচ্চতা ২৮৫ ফুট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৬০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের দোয়ানীতে রয়েছে তিস্তা ব্যারেজ যা সেচ প্রকল্পের জন্য ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হলেও গজলডোবা বাঁধের কারণে অচল হয়ে পড়েছে। গজলডোবা বাঁধের এক পাশে পানি টুইটুম্বর থাকলেও বাঁধের অপর পাশ থেকে বাংলাদেশ সমীন্ত পর্যন্ত পানির অভাবে শুকনো নদীতে বালি আর বালি, নেই কোনো জীবন প্রবাহ। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতেরও নদীর দুই ধারে জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি-লাটাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ-হলদিবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ কারণে তিস্তার দুপারের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনের জীবন চলছে অভাব, দু:খ আর দূশ্চিন্তা নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দেয় ভারত। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৫৪টি যা বন্ধ করে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করছে ভারত। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনার্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কার্যত তিস্তার নদীর পানি গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার গড় বার্ষিক পানির প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড)। গজলডোবা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর তা কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন প্রবাহ ১ হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ২০০-৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ভূপৃষ্ঠের পানির প্রবাহ হ্রাস এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার মানুষসহ জীব বৈচিত্র ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ২০১৪ সালের পর একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে ভারত। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গেল ১০ বছরে তিস্তা গিলেছে অন্তত ১০ লাখ কোটি টাকার সম্পদ। যার অন্যতম কারণ সংস্কারের অভাবে নাব্যতা হারিয়ে তিস্তার গভীরতা কমে গেছে। ফলে সামন্য পানিতেই সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও ভাঙনের মতো দুর্যোগ।

বিজ্ঞাপন

তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে থাকে। শুধু পরিবেশ নয় এর সুদুর প্রসারি ক্ষতিকর অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষময় যাতনাও সইতে হয় তিস্তা অববাহিকার মানুষকে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তার পানির ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান। এই গবেষণায় আরও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যদি পানি সমস্যার সমাধান করা না হয়, তাহলে তিস্তায় পানির ঘাটতির কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বছরে তিন মৌসুমে (আউশ, আমন, বোরো) একরপ্রতি জমির সেচ খরচ দিতে হয় ৪৮০ টাকা। সে হিসেবে শুধু বোরো মৌসুমে এক একর জমিতে সেচ দিতে হয় মাত্র ১৬০ টাকা। তিস্তার সেচের বাইরে অগভীর বা গভীল নলকুপ দিয়ে সেচ দিতে গুনতে হয় ৪৫০০ টাকা থেকে ৬০০০ টাকা।

তিস্তার ভাঙ্গনে সর্বশান্ত হচ্ছে নদী অববাহিকার বাসিন্দারা। তিস্তার উজানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৩২৮ মিমি এবং মধ্যাঞ্চলে ২৬১৯ মিমি। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৭৭-৮৪% বৃষ্টি সংগঠিত হয় জুন-সেপ্টেম্বর মাসে।এই স্বল্প সময়ে অতিবৃষ্টির কারণে অববাহিকা অঞ্চলের মাটি নরম হয়ে ফাটলের সৃষ্টি করে ভূমিধ্বসের উপযোগী করে তোলো। তিস্তা অববাহিকার উভয় পার্শ্বে বন ধ্বংসের কারণে অতিসহজে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে নিচু অংশের দিকে ধাবিত হয় এবং ভূমিধ্বসের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বনভূমি ঘন থাকলে এই পানি গড়িয়ে না পড়ে মাটিতে অনুপ্রবিষ্ট হতো এবং গ্রাউন্ড ওয়াটার লেবেলকে সমৃদ্ধ করতো। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই নেপালের কাঠমান্ডুতে ২৪ ঘন্টায় ৫৪০ মিমি বৃষ্টিপাতে ভূমিধ্বসে ও ভাঙ্গনে ৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার সেডিমেন্ট নদীগর্ভে বয়ে আনে। এরুপ অতিরিক্ত পলি ও কাদা মাটি জমে ড্যামের গেটের প্লেট ভেঙ্গে ফেলতে পারে আশংকায় সকল গেট খুলে দেয়া হয় ফলে সকল সেডিমেন্ট বা স্রাব ধূয়ে ভাটির অঞ্চল বাংলাদেশে এসে জমা হয়। এভাবে বাংলাদেশের ১৫১ কিমি অংশে প্রতিবছর ২ কোটি টন পলি ও কাদা তিস্তার বুকে জমা হয়ে নদী গর্ভ ভরাট হয়ে যায়। ৪০ বছর আগেও নদীটি বাংলাদেশ অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রস্থে ছিল ২ কিলোমিটার, শুষ্ক মৌসুমে ১ কিলোমিটার। তিস্তা যখন প্রস্থে ১ থেকে ২ কিলোমিটার ছিল, তখন পানির বেগ ছিল প্রচুর। সেই বেগে নদীর তলদেশ গভীর হতো। কৃত্রিমভাবে তিস্তার তলদেশ খনন করে অতীতে এর গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়নি, গভীর হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। অপরিকল্পিতভাবে নদী রক্ষা বাঁধ এবং ব্যারাজ নির্মাণের ফলে নদীটি এখন কোথাও কোথাও প্রস্থে প্রায় ১০ কিলোমিটার হয়েছে। নদীটি তার গভীরতা হারিয়েছে। কিন্তু বর্ষাকালের প্রশস্ততায় প্রতিবছর দুই পাড়ে যে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, তা দিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ বালু এসেও নদীর তলদেশ ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। এখন কোথাও কোথাও নদীর তলদেশ সমতল ভূমির চেয়ে অনেক উঁচু। তিস্তা নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর আর্থিক মূল্য এক লাখ কোটি টাকার কম হবে বলে মনে হয় না। প্রতিবছর পানি আটকে রেখে হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে বড় বড় আকস্মিক বন্যা হয়। রংপুর অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তারা অপেক্ষা করে আছে একদিন তিস্তা চুক্তি হবে, তিস্তা নদী সুরক্ষায় কার্যকর পরিচর্যা হবে। নদীপারের ক্ষতিগ্রস্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নদীর ভাঙন আর বন্যা থেকে মুক্তি চায়। নদীবিজ্ঞান, নদী প্রযুক্তি, নদী রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক বিষয়- এসব বিশেষ কিছুই বোঝেন না নদীপারের সাধারণ মানুষ। তারা চায় তাদের বাড়ি যেন ভেঙে না যায়।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে তিস্তা নদীতে মাছের মোট প্রজাতির সংখ্যা ৪৫টি তন্মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ সহজ লভ্য, ১০ প্রজাতির মাছ সচারচর পাওয়া যায় না এবং ১২ প্রজাতির মাছ অনেকটা দূর্লভ যা বিলুপ্তির পথে। বৈরালি মাছের প্রধান উৎস হলো পাহাড়ি নদী তিস্তা। অর্থাৎ পাহাড় বেয়ে নেমে আসা নদী তিস্তা দিয়ে এই মাছ বহমান। তিস্তার ধারা নামায় ব্রহ্মপুত্র হয়ে যমুনা নদীতেও এই মাছ মেলে। ফলে তিস্তা নদীর অববাহিকার জেলা নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধায় পাওয়া যায় এ মাছ। এই মাছটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা ইলিশ মাছের মতোই। তীব্র স্রোতে উজান থেকে ভাটির দিকে ছুটে চলে।বৈরালি মাছ গ্রীষ্মকালে বংশ বিস্তার করে থাকে। এ ছাড়াও তিস্তায় এক সময় পাওয়া যেত বোয়াল, আইড়, গুলশা, টেংরা, কালিবাউশ, পুঁটি, টাকিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে সেচ কাজের জন্য এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভাটিতে তথা বাংলাদেশ অংশে তিস্তায় প্রকট আকারে পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তায় আগে বহু প্রজাতির মাছ ছিল। এখন মাছের প্রজাতি কমে এসেছে। অনেক রকম ছোট-বড় কীটপতঙ্গ ছিল, এখন আর সেসব নেই। অতীতে নদীতে প্রচুর পরিমাণে শৈবাল দেখা যেত। এখন আর তা নেই। কচ্ছপ, শুশুক ছিল। এখন বর্ষা মৌসুমে কদাচিৎ শুশুক দেখা গেলেও কচ্ছপ আর নেই। এ নদীতে আগে শীত মৌসুমে প্রচুর পাখি আসত। এখন আর আগের মতো পাখিও আসে না।

অভিন্ন নদী হিসাবে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে উজানে তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে ভারত। আবার বন্যায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের নদী ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চোখের সামনেই ভেঙ্গে যাচ্ছে তাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শত বছরের পুরনো কবর কিংবা নতুন কবরে সাদা কাপড়ে শায়িত আপন জনের সদ্য লাশ ভেসে যাচ্ছে নদীর স্রোতে যা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে আত্মীয় স্বজন। তিস্তাকে ঘিরে এরকম হাজারো দু:খের করুন কাহিনীর শিকার রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলার মানুষ।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ৩৯ শতাংশ ভারত ও ২৫ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ শতাংশ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের তীব্র বিরোধিতার কারণে তিস্তার পানি চুক্তি আজও স্বাক্ষরিত হয়নি এবং কোন কালে হবে বলে বিশ্বাস হয় না।

দীর্ঘদিনের ক্ষয়-ক্ষতি ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে উত্তর বঙ্গ তথা রংপুরের মানুষ আর আশাবাদী নয়। তিস্তা পারের বাসিন্দাদের প্রত্যাশা, ভূ-রাজনৈতিক শক্ত প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে সূচিত হবে রংপুর অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নযাত্রা তিস্তা মহাপরিকল্পনা। তিস্তা অববাহিকার মানুষের দু:খ দুর্দশা দূর করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এগিয়ে এসেছে চীন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অফ চায়না (পাওয়ার চায়না), একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে এই প্রকল্পের জন্য একটি নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে প্রায় ৮.৫ হাজার কোটি টাকা। সমুদয় অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে চীনের একটি ব্যাংক।

চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে: বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ডান-বাম উভয় তীর ঘেঁষে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে বাস্তবায়ন করা হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা। প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে এক হাজার মিটারে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে ১০ মিটার। নদীশাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি বহন ক্ষমতা বাড়ানো, নদীর দুই পারে বিদ্যমান বাঁধের মেরামত করা, নদীর দুই পারে মোট ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা, ৫০টি গ্রোয়েন স্থাপন এবং নদী ড্রেজিংয়ের মাটি ভরাট করে নদীর দুই পারে ১৭০ বর্গকিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা হবে।

রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তরাঁ, পর্যটন কেন্দ্র, ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, কয়েক লাখ হেক্টর কৃষি জমি উদ্ধার, বনায়ন ইত্যাদি। তাতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাল্টে যাবে তিস্তা পাড়ের মানুষজনের জীবনমান। দ্বিতীয়ত: তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের অতিরিক্ত পানির আর প্রয়োজন পড়বে না বাংলাদেশের। কারণ, তিস্তা নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে বন্যায় ভাসবে না গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ। উপরন্তু সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষিত থাকবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এলাকায় বহু কল-কারখানা তৈরি হবে এবং ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সবদিক দিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এই এলাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনীতি, প্রকৃতি, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ মানুষের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি অবদান রাখবে। নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি-সেচ ব্যবস্থা, মাছচাষ প্রকল্প, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ ধরণের ব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রাকৃতিক উপায়ে পানি ও প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণের সাথে তুলনা করা যায়। ফলে পরিবেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না এবং আমাদের ভাটিতে অন্য কোনো দেশ না থাকায় তা আন্তর্জাতিক আইনের কোনো লঙ্খন হবে না বলে স্বীকৃত। ফলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি হবে। তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এবং সুফল মিললে কুড়িগ্রাম জেলা সহ অন্যান্য জেলার নদী গুলোর ক্ষেত্রে অনুরুপ ব্যবস্থা গ্রহণে এ বাস্তব অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে। ফলে এ অঞ্চলে ঘটবে এক ব্যাপক টেকসই উন্নয়ন সমৃদ্ধি যা স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর