ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু— খুলবে অপার সম্ভাবনার দুয়ার
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:১৭ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৪
ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিশাল এ আন্তর্জাতিক নদ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর হয়ে গাইবান্ধা জেলায় প্রবেশ করেছে। এ নদের নতুন প্রবাহের শুরু থেকেই রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যোগাযোগসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রাম এবং সবচেয়ে দরিদ্রতম উপজেলা কুড়িগ্রামের রাজিবপুর। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ও যন্ত্রণা এবং দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘদিন ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতুর নির্মাণের দাবি করে আসছেন সুবিধাবঞ্চিত এ জনপদের মানুষ।
এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে কৃষিকাজ। অনেক পরিশ্রম করে ফসল ফলালেও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকার কারণে এ অঞ্চলের কৃষকরা তাদের ফসলের উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই কম দামে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক চড়া দামে ক্রয় করতে হয়। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে চিলমারী, দীর্ঘ এই পথে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিতে হয়। পারাপারে নৌকাই একমাত্র ভরসা। আর ভরসার সেই নৌকায় ভর করে পারাপার হতে গিয়ে হাজারো মানুষের সলিল সমাধি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রে একেকটা মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বারবার দাবি উঠেছে সেতু নির্মাণের। চিলমারী হতে রৌমারী পর্যন্ত সেতুর দাবিতে একাধিকবার আন্দোলনও দানা বাঁধে। সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস মিলে, পরিদর্শন করা হয় সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান। কিন্তু এ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টদের কচ্ছপ-গতির ভাবনায় এখনো অধরা রয়েছে স্বপ্নের সেতু।
পরিদর্শনে ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, রৌমারী উপজেলার বলদমারা থেকে চিলমারী উপজেলার ফকিরের হাট পয়েন্টের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। চর রাজিবপুর উপজেলা থেকে চিলামারীর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে বলদমারা থেকে ফকিরের হাট অ্যালাইমেন্টে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার আয়তনের ২০০ বিঘার চর এবং আড়াই কিলোমিটার আয়তনের বাঘুয়ার বাঁশদহের চর প্রায় ৩০ বছর পূর্বে গঠিত হয়। পানির লেভেল থেকে ৮-১০ ফুট ওপর চর দুটি অবস্থিত। এখানে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার অংশ ভায়াডাক্ট এবং ৪ দশমিক ২০ কিলোমিটার জলভাগের অংশে ক্যাবল স্ট্রেইট সেতু নির্মাণের জন্য সাশ্রয়ী ও যুক্তিযুক্ত। চিলমারী থেকে রৌমারী সেতুর সঙ্গে রেলসংযোগ রাখতে মতামতও দেওয়া হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদ দেশের ৬৪তম পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত জেলা কুড়িগ্রামকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় একটি বিরাট চ্যালেজ্ঞ ও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে রৌমারি ও রাজিবপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার তদারকির দায়িত্বে রয়েছে জামালপুর জেলার বিজিবি এবং উক্ত উপজেলা দুটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ জামালপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। যা অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করে। দূর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে লাশের পোস্ট মর্টেম করার জন্য জেলা সদরে আনতে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় হয়। দূর্গম চর এলাকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ে আসা লাশ পঁচে যাবার উপক্রম হয়। বন্যা কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রত্যন্ত চর এলাকায় ত্রাণসহ সরকারি অন্যান্য সেবা কার্যক্রম অসহায় ও দূস্থ্ মানুষের নিকট দ্রুত সময়ে পৌছানো সম্ভব হয় না। বিরামহীন বর্ষণ, ঘরের মধ্যে পানি, মধ্যরাতে প্রসূতির প্রসব বেদনার কাতরতা, শিশুর ডায়রিয়া, বৃদ্ধার শ্বাসকষ্টে ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হয় এ অঞ্চলে বসবাসকারীদের।
ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ব্রিজ নির্মিত হলে কুড়িগ্রাম হবে রংপুর বিভাগের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। নদটির বিশাল সম্পদকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে এ অঞ্চলের সার্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘটবে যুগান্তকারি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। ব্রহ্মপুত্র নদের বিশাল জলরাশিকে কাজে লাগানোসহ ভাঙ্গনরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া গেলে সমস্যা পরিণত হবে সমাধানে, যা বিকশিত হবে সম্পদে। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর সেতু নির্মিত হলে কুড়িগ্রাম থেকে যেমন সহজেই ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সহজে যাতায়াত করা যাবে তেমনি রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলা, সমগ্র রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পক্ষান্তরে ভারতের কতগুলো অঙ্গরাজ্য যেমন- পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি জেলাসহ আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়সহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের উল্লিখিত বিভাগের জেলাগুলোর সহজ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। ভারতও প্রয়োজনে তার অঙ্গরাজ্যগুলোর সাথে সহজ যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে। এমনকি এর মাধ্যমে নেপাল ও ভুটানের সাথে কানেকটিভিটি বাড়ানো সম্ভব হবে। এ সেতুকে কেন্দ্র করে কুড়িগ্রাম তথা রংপুর বিভাগে সংগঠিত হবে ব্যাপক অর্থ নৈতিক কর্মকাণ্ড যার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা হলো।
কুড়িগ্রামে অনেক শিল্পকারখানা, বিশেষ করে কৃষিজ পণ্য সংরক্ষণাগার, গার্মেন্টস শিল্পের কাচাঁমাল তৈরির কারখানা এবং ইপিজেড ভিত্তিক কলকারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গ্যাস সংযোগ না থাকায় এ অঞ্চলে উন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অদ্যাবধি সম্ভব হয় নি। দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্প- কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে বগুড়া, রংপুর এবং সৈয়দপুর সঞ্চালন পাইপলাইনের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় মেয়াদ আরও সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্ধিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ যে সমাপ্ত হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম বা লালমনিরহাটে গ্যাস সংযোগ পাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার বলে অনেকে মনে করেন। অথচ ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ব্রিজ নির্মিত হলে অতিসহজেই গ্যাসের পাইপ লাইন কুড়িগ্রাম দিয়ে রংপুর বিভাগের অন্যান্য জায়গায় সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেন। কারণ কুড়িগ্রামের পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুর পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ চলে এসেছে। গ্যাস সংযোগ এলে কুড়িগ্রাম দিয়ে লালমনিরহাট জেলায়ও গ্যাস সংযোগ বিস্তৃত করা যাবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান, নেপাল, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি যোগ্য কারখানা গড়ে তোলা যাবে। উত্তরাঞ্চলের পার্বর্তীপুর রেলওয়ে হেড ডিপোতে জ্বালানি তেল রেলের ট্যাঙ্ক ওয়াগান পরিবহন করা হয়। আমদানিকৃত ইস্টার্ন লিমিটেড এবং স্থানীয় অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত জ্বালানি তেল চট্রগ্রামের প্রধান স্থাপনায় মজুদ করা হয়। সেখান থেকে পানি পথে দৌলতপুর ডিপো ও খুলনায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে ট্যাঙ্ক ওয়াগানের মাধ্যমে পার্বর্তীপুরে রেলের হেড ডিপোতে পাঠানো হয়। এ সময় লাগে কমপক্ষে ৭ দিন। তাছাড়া এভাবে তেল পরিবহন করা ব্যয়বহুল ও ঝুকিপুর্ন। ফলে সরকার ভারত থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ভারতের মুলানীগড় হতে শিলিগুড়ি রেল টার্মিনাল পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার পাইপ লাইন রয়েছে। এখন শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল হতে পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মান করা হয়। এরমধ্যে ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশে ১২৫ কিলোমিটার। ১০ ইঞ্চি ব্যাসের এই পাইপ দিয়ে বছরে ১০ লাখ টন ডিজেল পরিবহন করা সম্ভব হবে। ডিজাইন অনুযায়ী আইবিএসপিএলের মাধ্যমে বার্ষিক ১০ লাখ টন ডিজেল নুমালিগড় রিফাইনারী থেকে পার্বতীপুর ডিপোতে গ্রহণ সম্ভব হবে। বর্তমানে পার্বতীপুর ডিপোর চাহিদা দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৫০০ টন। ২০২৩ সালের ১৮ মার্চ থেকে ভারতের তেল এ প্রক্রিয়ায় আমদানী শুরু হয়েছে। রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উত্তরবঙ্গের রংপুর ও চিলমারী ডিপোর ৫০০ টন দৈনিক চাহিদা। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর সেতু নির্মিত হলে পরবর্তীতে পাইপের মাধ্যমে কুড়িগ্রামের চিলমারী দিয়ে এ তেল বৃহত্তর ময়মনসিংহ পর্যন্ত সরবরাহ করা যাবে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও বানিজ্যের ক্ষেত্রে আরও নতুন নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এমনকি ভারত সরকার তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ বিভিন্ন রাজ্যে এ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। বাংলাদেশের স্থলবন্দর গুলো ভারত, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারের স্থল কিংবা নদী দ্বারা সিমান্তে অবস্থিত। দেশে মোট স্থল বন্দরের সংখ্যা ২৪টি। বিবিআইএন এমভিএ বা বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল মটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয় ২০১৫ সালের ১৫ জুন। এ চুক্তি অনুযায়ী উল্লিখিত চারটি দেশের যানবাহন চলাচল, মালামাল পরিবহন ও জনসাধারণ প্রয়োজন অনুযায়ী যাতায়াত করতে পারবে। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর সেতু নির্মিত হলে মোট ২৪টি স্থল বন্দরের মধ্যে ১৬টি স্থল বন্দর সরাসরি উল্লিখিত চারটি দেশে সহজ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাবে। যার সহজ মাধ্যমে হবে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত সেতু। এ সেতুর মাধ্যমে এ সকল স্থল বন্দরের আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বাড়বে এবং পিছিয়ে থাকা কুড়িগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা, বাণিজ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্প্রসারণশীল আবহের সৃষ্টি হবে।
ব্রহ্মপুত্রের ওপর সেতু নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। এই সেতু শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হয়। এছাড়া যমুনা নদীর ওপর নির্মিত একমাত্র যমুনা বহুমুখী সেতুর ওপর চাপও কমবে। এই সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ তৈরি হলে তা ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের সর্ব উত্তরের জেলাগুলোকে রেলপথেও সরাসরি যুক্ত করবে। আগামীর বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল করতে ব্রহ্মপুত্র সেতু অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি