Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন হবে ২৫-এর বিশ্ব রাজনীতি

অলোক আচার্য
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:৫০

নতুন একটি বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব। চলতি বছর শুরুই হয়েছিল যুদ্ধ এবং তীব্র প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে। বছর শেষেও সেই যুদ্ধই রয়ে গেছে। কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যদিও প্রথম সময়ের ইউক্রেন দৃশ্যমান অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। আলোচনার কথাও চলছে। রাশিয়ার ভূখন্ডে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দিয়ে আঘাতের অনুমতি যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তারপরও মনে হচ্ছে এই যুদ্ধ এখন শেষের দিকে। ইউক্রেনের একটি বড় অংশ রাশিয়া দখল করেছে। বিপুল সংখ্যক সৈন্য দুই দেশেরই মারা গেছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। তবে এখনই থামছে না যুদ্ধ। হয়তো আরও কিছুটা দীর্ঘায়িত হবে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের হামলা এখনও প্রাণ কাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

চলতি বছরটা ছিল কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের বছর। নির্বাচনগুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই নির্বাচনগুলোর জয় পরাজয়ের উপর আগামী বছরের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে একবার দায়িত্ব পালনকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র আর কিছুদিন হাতে আছে। তিনি যুদ্ধ বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বারবারই তিনি বলেছেন তিনি ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ বন্ধ হবে। পৃথিবীবাসীও সেটাই আশা করছে। কিন্তু সেই শর্তগুলো এত সহজও হবে না। তাছাড়া বিশ্ব একটু উদ্বিগ্নও রয়েছে। চীনের সাথে বাণিজ্য প্রতিযোগীতা যুদ্ধে রূপান্তর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটা আগেও আমরা দেখেছি। যদিও চীনের প্রেসিডেন্টকে ট্রাম্প শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমরাও চাই এই সম্পর্ক কিছুটা ভালো থাক আগামী বছরগুলোতে। এরই মধ্যে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্যাপক পট পরিবর্তন ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিনিয়তই ভূরাজনীতির চিত্র পরিবর্তন ঘটছে। ভূরাজনীতিতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থিররাখা, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্পর্কের মেরুকরণ বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। দেশের সরকার পরিবর্তন হলে পরিবর্তন হয় সেই দেশের নীতি নির্ধারণের বিষয়। কারণ এখন এক দেশের সাথে অপরাপর বহুদেশ জড়িত থাকে বা নির্ভরশীল থাকে। মিত্রতা থাকে এবং এর বিপরীতটাও থাকে। প্রভাব পরে সে কারণেই। যার সাথে সম্পর্ক ভালো তার সাথেই বেশি ঘনিষ্টতা দেখা যায়।

এরপর ভারতের নির্বাচনও উল্লেখযোগ্য। জনসংখ্যায় সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। ভারতে আবারো ক্ষমতায় এসেছে মোদী। তবে এনডিএ জোট আগের মতো সুবিধা করতে পারেনি এবার। বরং কংগ্রেস উঠে এসেছে সুবিধাজনক স্থানে। ভারত ও চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়ে একটি অপ্রকাশ্য প্রতিযোগীতা বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। মালদ্বীপের নির্বচানে মইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সাথে সম্পর্ক তিক্ত হতে আরম্ভ করে। চীন ঘেঁষা বলে পরিচিত মোহাম্মদ মইজ্জু বেশ কঠোর অবস্থানে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত বছরের শেষ দিকে কিছুটা উন্নতি হয়। মালদ্বীপ মারাত্বক অর্থনৈতিক সংকটে পরে এবং এ নিয়ে দুই বন্ধু দেশের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় পৌছে। তবে এতে মইজ্জুর ভারতের প্রতি মনোভাব কতটা নমনীয় হয়েছে তা অবশ্য স্থিরভাবে বলা সম্ভব না। তার পরবর্তী কয়েকটি সিদ্ধান্তের গতি প্রকৃতি দেখে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

ক্ষমতার বদল হলেই বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, ক্ষমতার বদল ঘটলে কি ঘটতে পারে? ক্ষমতার বদল হয়েছে এবং হচ্ছে। এর প্রভাবে অনেক কিছুই হতে পারে। ক্ষমতার বদল হলে সে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, পৃথিবীতে যুদ্ধ থামতে পারে আবার আরও জোরেশোরে যুদ্ধ বাঁধতে পারে। কিছুটা ধারণা করা যায় এ বছর যুদ্ধ হয়তো কমবে। যদিও এসব সম্ভাবনার কথা, নিশ্চিত নয়। কিন্তু হতে পারে। বিশ্ব একটি নতুন বিশ্ব দেখতে পারে। পরিবর্তন আসবেই তা হোক ইতিবাচক বা নেতিবাচক। পৃথিবী আরও বেশি অসহিঞ্চু হয়ে উঠতে পারে আবার শান্ত। শান্ত পৃথিবী সবাই চায়।

স্বাভাবিকভাবেই যেসব দেশে প্রয়োজনীয় সরবরাহ রয়েছে এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ন অবস্থান রয়েছে সেখানে বিশ্বের ফোকাসটাও সেখানেই থাকবে। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ এন্ড টেক নীতি। এখানে উদারনীতি বলে কিছু নেই। রয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক এমন একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে প্রতিনিয়তই দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে। পরাশক্তিগুলো নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করছে। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে। তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক,বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তাছাড়া রয়েছে ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়। এসব নির্বাচন আগামী বিশ্বের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রশ্ন সামনে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসন আর কতদিন চলবে অথবা ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ থামবে কবে? এসব ছাড়াও আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন এবং রাশিয়ার সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও দেখার বিষয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পুতিনের সাথে সম্পর্ক কিছুটা উন্নতির আশা করা যেতে পারে। যদি মোটামুটিভাবে সব মিলে যায় তাহলে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ইউক্রেনকেই ছাড় দিতে হবে বেশি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যদি না থামে তো এ যুদ্ধ মারাত্বক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কারণ ইতিমধ্যেই অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়াা সম্ভব হবে না।

চলতি বছরে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বছরের শুরুতেই ছিল ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব। রয়েছে ন্যাটোর নতুন সদস্য পাওয়া এবং রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা। ন্যাটোর বিস্তার অব্যাহত থাকলে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব ভিন্নমাত্রা পাবে। এমনকি একটি বড় যুদ্ধেরও মুখোমুখি হতে পারে পৃথিবী। এরই মধ্যে ইরানের ইব্রাহিম রাইসি নিহতের ঘটনায় কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। ইরানের নেতা হিসেবে রাইসি ইরানে যথেষ্ট প্রভাব বজায় রেখেছিলেন এবং খামেনির পর তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। রাইসি ইরানের কট্টরপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পশ্চিমা রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া অথবা সম্প্রতি ইসরাইলের মাটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা করা এসব সাহসী কর্মকান্ডের জন্য তিনি ইরানে প্রশংসিত। বলা হয়, তার সাহসী ভূমিকাতেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এতদূর এগিয়েছে যা বিশ্বব্যাপী মাথাব্যাথার কারণ। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়ার পর শুরু হয় নানা গুঞ্জন। অভিযোগ ওঠে তাকে হত্যার বিষয়েও। তবে শেষ পর্যন্ত এটি শান্ত হয় এবং মাসুদ পেজেশকিয়ান আসেন রাইসির জায়গায়।

এ বছরেই ভারতের সাথে কানাডার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সে পরিস্থিতি এখনও খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। খুব মিত্র থেকে আপাতত দুই দেশই অনেকটা দুরত্বে অবস্থান করছে। শ্রীলঙ্কায় এসেছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক। দুর্নীতিসহ অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হলে গভীর সংকটে পরে যায় শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করা এবং দিশানায়েকের ক্ষমতায় আসা নতুন শ্রীলঙ্কা গড়ার পথে এগিয়ে চলেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে নিজ দেশে। আর মাত্র কয়েকদিন আগে সিরিয়ার আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে রাশিয়ায়। নতুন পতাকা নিয়ে দেশটি এখন নতুন যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই বিশ্ব হোক মানুষের, বিশ্ব হোক মানবতার।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এএসজি

অলোক আচার্য বিশ্ব রাজনীতি মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর