মূল্যস্ফীতি দেশে দারিদ্র্যের মূল কারণ
১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৮ | আপডেট: ১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:১১
বিগত ছয় মাস ধরে চলছে ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। সর্বশেষ গত মাসেও তা ছিল ১২ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রচুর মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করলেও অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। অর্থনৈতিক সামান্য ধাক্কা বা অভিঘাতেই তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার জোর আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আনুমানিক হিসাবে এর পরিমাণ অন্তত দুই কোটি। বর্তমান পরিস্থিতিতেও এরাই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন। চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কমিয়ে তা দিয়ে পুষ্টি ব্যয় নির্বাহের চেষ্টাও করছেন অনেকে। এ পরিস্থিতিতে এখন রোগ-বালাই ও অশিক্ষা বেড়ে গিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন সক্ষমতাও কমে আসার জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি) গ্রহণ করতে হয়, তাতে প্রতি মাসে ব্যয় হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটিকেই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক হিসাব অনুযায়ী, জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ব্যয় করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার গ্রহণে একজন মানুষের ব্যয় হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।এর কারন হিসাবে ধরা হয় সব জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে মানুষ কম কিনে কম খেতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ভাত হয়তো খাচ্ছে তবে মাছ-মাংস, ফলমূল-দুধ কম খাচ্ছে, যার স্বাস্থ্যগত প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে শিশু-কিশোরদের মধ্যে।’ ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণের জন্য নির্ধারিত ফুড বাস্কেটের প্রতিটি উপাদানের মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে; এজন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর পেছনে সাম্প্রতিক সময়ে চালের ১৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া মুরগি, ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও সব ধরনের সবজির মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের ব্যয়কে উস্কে দিয়েছে। পুষ্টি ব্যয় বাড়ায় দেশে অপুষ্টি ও রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কম খাবার গ্রহণের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুষ্টিহীনতা বেড়ে যায়। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও কমে যায় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। ফলে নানাবিধ রোগ-ব্যাধির প্রকোপও বাড়ে এবং জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার তুলনামূলক বেশি বলে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। মূল্যস্ফীতির চাপ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকট তাদের ওপরেই সবচেয়ে মারাত্মক আকারে জেঁকে বসেছে। আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরতদের হারের চেয়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীর হার বেশি। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানরতরাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে। জাতিসংঘের এ খাদ্য সংস্থাটির সাম্প্রতিক আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যে ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষ নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে অনেকে চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দ্রুত বাজার পরিস্থিতি ও বিনিয়োগ চাঙ্গা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও মানুষের প্রত্যাশা আরও বেশি।
দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। দাম বেঁধে দেয়া, কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহার, বাজার তদারকি এবং দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে লক্ষণীয় নয়। উল্টো দিন দিন মূল্যস্তর আরও স্ফীত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নয়তো জনগণের ওপর আর্থিক চাপ আরও বাড়তে থাকবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো কঠিন হবে।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পদক্ষেপ হলো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বিশেষ করে নীতি সুদহার বাড়িয়ে অর্থপ্রবাহে লাগাম টানা। এদিকে দেশে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়ার পরও দীর্ঘদিন ঋণ ও আমানতের সুদহার যথাক্রমে নয়-ছয় করে রাখা হয়েছিল। উপরন্তু সে সময় বিগত সরকারের অন্যতম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে সেই পদক্ষেপের কার্যকর সুফল পাওয়া যায়নি। আবার বর্তমানে যখন সুদহার বাড়ানো হচ্ছে, সংকটে থাকা অর্থনীতি আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। বাড়তি সুদের কারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়েছে। গত আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এক ধরনের শ্লথগতি নেমে এসেছে, যা উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। চাহিদামাফিক পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যার কিছুটা প্রভাব থাকলেও বাস্তবে সংকট তৈরি হয়েছে অদক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে। যে কারণে আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করেও এর প্রভাব বাজারে দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সরকারকে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে যাতে মূল্যস্তর সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা সেভাবে না থাকায় বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের মাধ্যমে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্বনীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। পাশাপাশি বাজারকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে তুলতে হবে। এর জন্য কেবল বাজার তদারক করলেই চলবে না। সমস্যার মূল চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে চাহিদামাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতিসংঘ ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসের প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেছে যা হচ্ছে, ‘ন্যায়, শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অপব্যবহার বন্ধ করা’। গত ১৭ই অক্টোবর বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হয়েছে । বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায় দারিদ্র্যতা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি)-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০০-২০১০ সাল মেয়াদে গড়ে প্রতি বছর দারিদ্র্য কমেছে ১.৭৪% হারে, যা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতি বছর ১.২% হারে দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যের চেয়ে বেশি। ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬.৭%, যা ২০১৬ সালে হ্রাস পেয়ে ২৪.৩% এ দাঁড়িয়েছে। আবার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে গড় দারিদ্র্যের হার ১৮.৭% যা আমাদের কাছে ইতিবাচক হলেও দেশের মোট জনসংখ্যার হার অনুযায়ী এটি অশুভ সংকেত। আরও দেখা যায় যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্য রয়েছে। কিন্তু সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারনে দারিদ্র্যাবস্তার অবনতি লক্ষণীয় এবং দেশের বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে যদিও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই এগুতে হবে ধৈর্য্য সহকারে এই হউক বর্তমান সময়ের সবছেয়ে বড় কাজ।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই