Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশে কবে হবে শিষ্টাচার এবং সহনশীলতার রাজনীতি?

সাজ্জাদ কাদির
২ মে ২০২৩ ১৬:০৭ | আপডেট: ২ মে ২০২৩ ১৬:১৫

গত ২৪ এপ্রিল দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু শপথ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। দেশের সর্বস্তরের জনগণ তাঁকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বিদেশ থেকেও একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তা আসছে। ২৪ এপ্রিল শপথের দিনেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় মো. সাহাবুদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শপথ নেওয়ার পরের দিন ২৫ এপ্রিল জাপানের সম্রাট নারুহিতো, প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তারেল্লা, ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইদ ইব্রাহিম রাইসি, মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান হাজি আহমেদ শাহ আল মুস্তাইন বিল্লাহ এবং সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব পৃথক বার্তায় তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পাঁচটি দেশের প্রেসিডেন্ট।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছাড়াও নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিসটো, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট টোকায়েভ, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ও সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালাইন বেরসেট। এর বাহিরেও আরও অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন। একজন ব্যক্তি মর্যাদাপূর্ণ পদে আসীন হলে শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানানোটাই দেশে-বিদেশে শিষ্টাচার।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, অপরিচিত একজনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে সরকার আবারও একতরফা নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন। শপথের দিন সোমবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরেই বিএনপি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি নতুন রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানানোর ভদ্রতা দেখাতে পরেনি। এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল মোটেই রাজনৈতিক উদারতা এবং শিষ্টাচারের পরিচয় দেননি। একজন রাজনৈতিক নেতা যদি এমন সংকীর্ণ মনমানসিকতা নিয়ে থাকেন তাহলে তার নিকট ভালো কিছু আশা করা যায় না। রাষ্ট্রপতিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করার প্রেক্ষিতেই বলতে হয়, যে মির্জা ফখরুল এমন মন্তব্য করলেন ক’বছর আগেও সেই ফখরুলইবা কতটা পরিচিত ছিলেন? তিনি ছিলেন ঠাকুরগাঁও পৌরসভার এক সময়ের চেয়ারম্যান, একবারের সংসদ সদস্য আর একবার ঘটনাক্রমে নিজের এলাকা ছেড়ে বগুড়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। যদিও শপথ নিতে পারেননি। অবশ্য একবার বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। অপেক্ষাকৃত এমন দুর্বল রাজনৈতিক কেরিয়ার নিয়ে তার মত একজন পিছনের সারির নেতা হঠাৎ করে রাতারাতি বিএনপির মত একটি বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলেন কিভাবে? বিএনপিতে কী ডাকসাইটে নেতার অভাব ছিল? নিশ্চয়ই ছিল না। কাজেই কারো সম্পর্কে মন্তব্য করবার আগে প্রত্যেকের নিজের চেহারাটা আগে আয়নায় দেখা উচিৎ। নতুন রাষ্ট্রপতি তার কর্ম অনুযায়ী যথেষ্ট পরিচিত এবং সোচ্চার ছিলেন। হ্যাঁ এ কথা সত্য যে, অন্য অনেকের মত তিনি সেইভাবে প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। তিনি খানিকটা প্রচার বিমুখ। এই দেশে এমন বহু মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে নতুন রাষ্ট্রপতির চেয়ে অনেক দুর্বল কেরিয়ারের মানুষ কিন্তু বহুল পরিচিত। এর কারণ হল তারা নিজেদের প্রমোট করার জন্য টিভি, পত্রিকার লোকদের নানা রকম কায়দায় লবিং করে থাকে। নতুন রাষ্ট্রপতি এসব মিডিয়া লবিংয়ের ধারে কাছেও কখনও ছিলেন না। তার চেয়ে অনেক নিচের স্তরের লোকজনও আজকাল মিডিয়া উইং পোষে। অথচ তিনি আওয়ামী লীগের মত এক বিশাল রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও ওসবের ধারে কাছেও যাননি। ব্যক্তিগতভাবেও তিনি নিজেকে কোথাও কখনও প্রচার বা মার্কেটিং করেননি। কোনো গণমাধ্যমের কেউ বলতে পারবে না যে তিনি কখনও কাউকে বলেছেন তোমার টিভিতে আমাকে ডেকো কিংবা তোমার পত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখো, প্রমোট করো ইত্যাদি। তিনি নিজেকে নিয়ে নয় বরং সবসময় দেশকে নিয়ে, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে ভাবতেন। তাই সবসময় দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে কলাম লেখার মাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন। জাস্ট এতটুকুই তার সাথে গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্টতা।

বিজ্ঞাপন

নতুন রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিএনপি কিংবা মির্জা ফখরুল ইসলামের এতটা গাত্রদাহের কারণ কী? রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন নিয়মতান্ত্রিকভাবে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন এজন্যই কী অস্বস্তির কারণ? রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন একজন অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এজন্যই কী তাদের অস্বস্তির কারণ? তাহলে বলতেই হয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়উর রহমান বন্দুকের নল ঠেকিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিএনপি তাদের শাসনামলে অতীতে দেশের স্বধীনতা বিরোধী রাজাকারকে পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী,মন্ত্রী বানিয়েছে। বিএনপি কী আওয়ামী লীগের কাছেও তেমনটা প্রত্যাশা করেছিল? কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একজন যোগ্যতম ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছেন। মোটা দাগে দুটো দলের পার্থক্য এখানেই।

আর ব্যক্তি মির্জা ফখরুলের কথা যদি বলি, তিনি হচ্ছেন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মির্জা রুহুল আমিনের পুত্র। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় ফখরুলের বাবার নাম ৭১০ নম্বরে ছিল। তার বাবা রাজাকার আর মির্জা ফখরুল ১৯৭১-এ কী করেছেন? যে সময়টিতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল মানুষ সেই সময়ে যেহেতু বাবা পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিলেন সেহেতু তিনি হয় বাবার সেহযোগী কিংবা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অথচ যে রাষ্ট্রপতিকে তিনি চেনেন না বলছেন সেই রাষ্ট্রপতি ১৯৭১-এর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ছাত্র, যুবক অবস্থায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা, বিচারাঙ্গন, দুদক কমিশনার থাকা কালীন আজীবন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা মানুষ। একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ তিনি। তার পুরো জীবন পাঠ করলে দেখা যায় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একজন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ জীবনের মাঝপথে বিচারবিভাগীয় ক্যাডার সার্ভিসে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। চাকুরি থেকে স্বাভাবিক অবসরের পর তিনি কিন্তু ঘরে বসে থাকতে পারেননি। আবারও রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। তিনি ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ লাভ করেন। ছাত্র, যুব রাজনীতির দীর্ঘ বিরতির পর তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার মাত্র তিন বছরের। এত অল্প সময়ের কেরিয়ারে রাষ্ট্রপতি পদের মত মর্যাদাপূর্ণ পদে যাওয়াতে শুধু যে বিএনপির গাত্রদাহের কারণ হয়েছে তাই নয়। নিজ দল আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতার গাত্রদাহের কারণ ঘটেছে, স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও নেপথ্যে নেতিবাচক কাজ করার চেষ্টা যে করেছে তা বোঝা যায়। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কাছে হালে পানি পায়নি। নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নির্বাচিত হওয়া আটকাতে উচ্চ আদালতে দুটি রিট হয়েছিল। আবেদন দুটি সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে দিয়েছে।গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এই রিটের নেপথ্যে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ইন্ধন ছিল। এছাড়া আরও হোমড়াচোমরা জড়িত থাকতে পারে। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানেও কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে দেখা যায়নি। এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার গাত্রদাহ হয়েছিল।

মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিংবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক মাত্র কয়েক বছরের রাজনৈতিক কেরিয়ারে দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন। পৃথিবীতে এমন ভুরি ভুরি উদহারণ আছে। সেই বিচারে আমাদের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছাত্র, যুবনেতা এবং সর্বশেষ অবস্থান ধরলে রাজনৈতিক কেরিয়ার অনেক দীর্ঘ। বাড়তি হিসেবে আছে বিচারক এবং আইনজীবী হিসেবে কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়ে তাঁর কেরিয়ার বর্ণাঢ্য। কাজেই আসুন তাঁকে দল মতের উর্ধ্বে উঠে অভিনন্দন জানাই। শিষ্টাচার এবং সহনশীলতার রাজনীতি চর্চা করি।

লেখক: তথ্যচিত্র, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

দেশে কবে হবে শিষ্টাচার এবং সহনশীলতার রাজনীতি? মত-দ্বিমত সাজ্জাদ কাদির

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর