Sunday 07 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাতীয় নির্বাচন ২০২৬: গণমুখী রাজনীতির পুনর্জাগরণে বিএনপির নতুন দিগন্ত

ড. মো. আমিরুল ইসলাম
৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৯:০৮

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনে ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক পর্ব। দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতির মাঠে অনিশ্চয়তা, ভোটের অনাস্থা, প্রশাসনিক প্রভাব ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংকোচন জনগণকে রাজনীতি থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করেছে স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ। এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে গণমুখী রাজনীতির মাটিতে নতুন করে দাঁড়ানো। যেখানে জনগণই হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, এবং জনগণের সমস্যাই হবে রাজনীতির প্রধান ইস্যু।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্র, জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় কাঠামো ও আন্দোলনের রণকৌশল কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। জনগণের চোখে বিএনপি আবারও বিকল্প শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হতে হলে তাকে মাঠে ফিরতে হবে মানুষের জীবনের বাস্তব প্রশ্নগুলো নিয়ে। মানুষ আজ চায় জীবিকার নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। বিএনপি যদি এই জনজীবনের বঞ্চনাগুলোকেই রাজনৈতিক ভাষায় নয়, বরং নাগরিকদের ভাষায় তুলে ধরতে পারে, তবে সেই রাজনীতি হবে টেকসই, বিশ্বাসযোগ্য ও গণমুখী।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক প্রজন্মান্তরিত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বৈশ্বিক তথ্যপ্রবাহে বেড়ে উঠেছে, তারা আজ রাজনীতির বাইরে নয়, বরং রাজনীতির এক নতুন দর্শক ও অংশগ্রহণকারী শক্তি।আমরা যদি এই তরুণ সমাজের আকাঙ্ক্ষা, কর্মসংস্থানের উদ্বেগ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্নকে ধারণ করতে পারি, তবে সেটিই হবে তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা হতে হবে আধুনিক, তথ্যনির্ভর এবং অংশগ্রহণমূলক। এ সময়ের রাজনীতি কেবল বক্তব্য বা সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলে চলবে না , এটিকে একটি ধারাবাহিক যোগাযোগের প্রক্রিয়ায় নিতে হবে, যেখানে জনগণকে শোনা ও তাদের সঙ্গে মিশে থাকা-ই হলো নেতৃত্বের সত্যিকার প্রমাণ।

আমাদের সামনে এখন দুটি সমান্তরাল দায়িত্ব হতে পারে। একদিকে, দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নেতৃত্বের পুনঃবিশ্বাস তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে, জনগণের মাঠে নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হবে। অতীতের ত্যাগ ও সংগ্রামকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার না করে, সেটিকে অনুপ্রেরণার উৎসে রূপান্তরিত করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নতুন নেতৃত্বকে জায়গা দিতে হবে যারা স্থানীয় মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। একইসঙ্গে, নেতৃত্বের নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে সেটিই হবে বিএনপির সবচেয়ে বড় সাহসিকতা এবং জনগনের পক্ষে থাকার বার্তা।

বর্তমান সময়ে রাজনীতি কেবল নির্বাচনের দিন সীমাবদ্ধ নয়। এটি হয়ে উঠেছে এক ধারাবাহিক বিশ্বাসের যাত্রা। জনগণ এখন সেই দলকেই পাশে চায়, যারা শুধু ক্ষমতার কথা বলে না, বরং মানুষের পাশে দাঁড়ায় সংকটের সময়,বন্যায়, বাজারে, হাসপাতালে, শিক্ষায়। আমাদের ি যদি মাঠ পর্যায়ের সামাজিক কর্মসূচি যেমন ‘গণশুনানি’, ‘দ্রব্যমূল্য পর্যবেক্ষণ কমিটি’, ‘অসহায় পরিবারের পাশে বিএনপি’-এর মতো মানবিক কার্যক্রম চালু করে, তবে সেটি শুধু রাজনীতির শক্তিই নয়, মানবিক আস্থার নতুন প্রতীক হয়ে উঠবে।

এখন সময় এসেছে বিএনপির জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং পুনর্গঠনের। জনগণের চোখে দলটি যেন কেবল বিরোধী বা ক্ষমতাশীল শক্তি নয়, বরং ‘পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি’র প্রতীক হয়ে ওঠে। এই ব্র্যান্ডিংয়ের কেন্দ্র হতে পারে আমাদের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান যিনি ইতিমধ্যে প্রবাসে থেকেও রাজনৈতিক নীতি ও দিকনির্দেশনায় দলের ঐক্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিবিসি বাংলায় তার সাক্ষাৎকার দেশে বিদেশে সকল মানুষকে ইতিবাচক হিসেবে বিএনপির দিকে প্রভাবিত করেছে, এছাড়াও সর্ব মহলে প্রশংসা পেয়েছে। সুতরাং তাকে ঘিরে একটি প্রজন্মভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার, যারা একইসঙ্গে আধুনিক, দেশপ্রেমিক এবং নীতি-নিষ্ঠ রাজনীতিতে বিশ্বাসী।

আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিএনপিকে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন এখন কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়— এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতন্ত্রের একটি মানদণ্ড হিসেবেও বিবেচিত। সুতরাং বিএনপি যদি বিশ্বমঞ্চে শান্তিপূর্ণ, সংস্কারমুখী এবং গণতান্ত্রিক দলের ভাবমূর্তি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে দেশের অভ্যন্তরেও এর ইতিবাচক প্রতিফলন পড়বে।

২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন তাই আমাদের জন্য কেবল একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়, বরং গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক সুযোগ। আমরা যদি জনগণের আস্থা পুনর্নির্মাণে সফল হই, যদি আন্দোলনের ভাষাকে আশা ও উন্নয়নের ভাষায় রূপান্তর করতে পারি ,তবে সেই নির্বাচনে শুধু বিজয়ই নয়, দেশের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও বিএনপির হাতে ফিরে আসবে।

আজ বাংলাদেশের মানুষ ক্লান্ত সংঘাতের রাজনীতি দেখে, তারা চায় টেবিল আলোচনার রাজনীতি, অংশগ্রহণের রাজনীতি, গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের রাজনীতি। বিএনপি তথা আমরা যদি এই মর্মবোধ ধারণ করতে পারে, তবে ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু এক দলের নয়, এদেশের নাগরিকদেরও পুনর্জাগরণের ইতিহাস হয়ে থাকবে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য- গবেষণা সেল, বিএনপি, চেয়ারম্যান- গভর্নিং বডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ ও ইয়েলো কনসাল্টিং এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর