পুরুষ তাহসান ও কূটবাঙালির নারীবিদ্বেষ
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:১৭
কুটিল বাঙালি আর বাতাবিলেবু মিডিয়াগুলোর স্বেচ্ছাচারিতায় রীতিমতো মেজাজ বিগড়ে যাওয়া অবস্থা। তাহসানের বিয়ে নিয়ে যতটা-না চর্চা হচ্ছে, তার চাইতে বেশি চর্চিত হচ্ছে তাহসানের বউয়ের বাপ কী ছিলো, বয়ফ্রেন্ড কে ছিলো, মিথিলা কী করেছিল— ইত্যাকার বিষয়াবলি নিয়ে।
তাহসানের শশুর কে? শশুর বরিশালের প্রয়াত যুবলীগ লীগ নেতা ফারুক আহমেদ, যিনি ‘পানামা ফারুক’ নামে অত্যধিক পরিচিত। ২০১৪ তে ক্রসফায়ারে লোকটি নিহত হন। ফারুকের পরিবারের দাবি ও রাজনৈতিক মহলে চর্চিত আছে যে, ফারুক নিহত হওয়ার প্রসঙ্গটা যতটা-না সন্ত্রাসের, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। কেননা, ১৯৯৬ সালে ফারুক বরিশালের সাংসদ ও প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বলা হয়ে থাকে, এরপরই ফারুক বনে জান বিএনপি-জামায়াতের কাছে একটা আতঙ্কের চরিত্র। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে ফারুক আত্মগোপনে চলে যান, এবং অতীতের কর্ম ও রাজনৈতিক প্রভাবে তার বিরুদ্ধে থানায় জমা হতে থাকে একাধিক মামলা।
বরিশাল নগরীর বাজার রোড এলাকায় ফারুকের বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। ফারুকের বড়ো বোনের নামানুসারে ঐ প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় ‘পানামা ট্রেডার্স’। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামানুসারে সে বরিশালে পরিচিতি পেতে থাকে পানামা ফারুক নামে। কথিত আছে যে, ফারুক ‘পানামা বাহিনী’ নামে একটা বাহিনী গড়ে তোলে, যাদের কাজ ছিলো বিরোধীপক্ষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তটস্থ করে রাখা। আর এ কাজগুলো সে করতো আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহের ছত্রছায়ায়। বলা হয়ে থাকে সে ছিলো আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর ডানহাত-বাঁহাত।
দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা ফারুক ২০০৯ এ আদালতে আত্মসমর্পণ করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় তৎকালীন সরকার বেশকয়টি মামলা থেকে তাকে মুক্তি দেয়। ফারুক ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। বরিশালের মানুষ তাঁকে আগের মতো কর্মকাণ্ডে ফিরে যেতে দেখেনি বলে নিশ্চিত হতে পেরেছি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন সে ২০১১-তে হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গ ছেড়ে মেয়র শওকত হোসেন হিরণের ঘনিষ্ঠ হয়ে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাংসদ হিরণ বরিশালের মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়, মৃত্যুর পরও সে এখনো সর্বদলের মানুষের কাছে বরণীয়। কিন্তু রাজনৈতিক কোন্দল ছিলো শেখ পরিবারের আত্মীয় আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহের সাথে। এ কোন্দলই যেন কাল হয় ফারুকের জীবনে। ২০১৪ তে র্যাবের সাথে ‘কথিত’ বন্দুকযুদ্ধে ফারুক নিহত হন। আর এই ফারুক আহমেদের মেয়ে রোজা আহমেদ, যিনি তাহসানের বর্তমান স্ত্রী। শশুর প্রসঙ্গে বেশি চর্চিত হওয়ায় বিষয়টি বিস্তর আলোচনা করলাম।
কিন্তু আসল কথা সেটা না। তাহসান তো তার শশুরকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছে শশুরের মেয়েকে। তো শশুর অতীতে কী ছিলো না-ছিলো সেসব দেখে তো তাহসানের বৈবাহিক সম্পর্ককে বিচার করা যাবেনা। ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সে বিচার প্রচলিত আইন করেছে, সর্বোপরি মারপ্যাঁচে পড়ে জীবনটাও হারাতে হয়েছে। তাহসান যদি সব জেনেশুনে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে, তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? মেয়েটির প্রেমের বিষয় নিয়েও বেশ বাজেভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দেখুন, প্রেমের সম্পর্ক এ-যুগে ডালভাতের মতো, এটা সমাজের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি-আমি ছিঃছিঃ করে এই সংস্কৃতির একটা কেশদণ্ডও ছিড়তে পারবোনা। কারো জীবনে অতীতে একটা কেন, একাধিক সম্পর্ক থাকতে পারে, এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়, তাদের সমস্যা না থাকলে আমাদের কেন? তারা সেলিব্রিটি, তাদের জীবন নিয়ে আপনাদের আগ্রহ আছে— এই তো? তাই বলে ব্যক্তিজীবন নিয়ে নোংরামি কেন করতে হবে! পরচর্চা আর কূটচর্চা দুটো তো এক নয়, এটি ভীষণ বাজে চর্চা।
এই ইস্যুতে আবার তাহসানের প্রাক্তন স্ত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলাকেও বেশ দৃষ্টিগোচরে আনা হচ্ছে। কোনো কোনো ভুঁইফোঁড় পত্রিকা বড়ো করে শিরোনাম বানিয়েছে ‘তাহসানের বিয়ে, কী করছেন মিথিলা? জানতে হলে ক্লিক করুন’। ভাইরে, সাত বছর আগে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মিথিলার সম্পর্কটা এখানে কোথায়? সে তাহসানের প্রাক্তন স্ত্রী, এটাই তো সমস্যা? —না। আসল সমস্যা এটা না। খুব সূক্ষ্মভাবে এখানে নারীবিদ্বেষ জড়িয়ে আছে। মিথিলা তাহসানকে ছেড়ে দিয়েছে বিষয়টি তো তা নয়, বরং তারা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছে। তো এখানে মিথিলাকে একা কেন, ধরার লাগলে তাহসানকেও ধরতে হবে। সৃজিতের সাথে মিথিলার ছিলো দ্বিতীয় বিয়ে, রোজার সাথে তাহসানের বিয়েটাও দ্বিতীয়— তাহলে এখন তাহসানকে বলছেন না কেন সে ‘বারোভাতারি’! সব দোষ নারীর? আমি পুরুষ একাধিক সম্পর্ক করতে পারবো, তুমি নারী, তোমাকে দিয়ে এসব হবেনা, তুমি করলেই বারোভাতারি— পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটাই গোঁড়া চিন্তা।
রোজার অতীত ও পিতৃপরিচয় এবং মিথিলার প্রতি ঘৃণা পোষণ— দুটো বিষয়ই ঠান্ডা মাথায় মেলান। এখানে তাহসানের চাইতে ঐ দুজন নারীকে নিয়েই বেশি চর্চিত হচ্ছে। মূলত এটা কূটবাঙালির নারীবিদ্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। কীভাবে নারীকে পচানো যায়, কীভাবে স্বগোত্রীয় ব্যক্তিকে মাইনাস করে নারীর দোষ খুঁজে বের করা যায়, এটিই কূটবাঙালির প্রধান কাজ, এ সত্যটা অনেকে হজম করতে পারছেনা। এ একপ্রকার নারীবিদ্বেষের সিলেক্টিভ জাজমেন্ট। নয়তো আপনি দেখবেন, ধর্মনেতা মামুনুলের পরনারীর সাথে আটক কিংবা কোনো এক পছন্দের ব্যক্তি ছয়/সাতটি বিয়ে করলেও এদের অনুভূতিদণ্ড সজাগ হয়না, যত চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে নারীকে নিয়ে, যদি নারীর ছোঁয়া সেখানে থাকে।
এমনকি এই কূটবাঙালি সমালোচনা করে নারীকে মেরে ফেলার ক্ষমতাও রাখে। ২০২২ সালে নাটোরের ঘটনাটা মনে করুন। ২২ বছরের ছাত্র মামুন বিয়ে করেছিল তারই কলেজ শিক্ষক ৪০ বছরের খায়রুন নাহারকে। একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে খায়রুন নাহার আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর আগে একটানা কয়েকমাস গণমাধ্যম আর সমাজের কটুসমালোচনার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিল তাদেরকে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাঁর থেকে পঁচিশ বছরের বড়ো শিক্ষিকাকে বিয়ে করেছে সেটা সমস্যা না, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া তাঁর থেকে বয়সে ছোটো নিক জোনাসকে বিয়ে করেছে সেটাও সমস্যা না, সমস্যা যত বাংলাদেশের কোনো এক রহিমপুর জেলার করিমগঞ্জের মফিজপাড়ার আবুলদের, তাদের সমাজে খায়রুন নাহারদের এসব করার অধিকার নেই। করেছেন তো চিড়িয়াখানার বানর হয়েছেন। আপনাকে টিকিট কেটে লাইন ধরে দেখতে আসা হবে। বাদামের খোসা, কলার খোসার মতো কটু কথাও ছুড়ে ফেলা হবে। এরকম শত-শত খায়রুন নাহারকে কূটবাঙালি আর তাদের বাতাবিলেবুর মিডিয়া মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে, কেননা সবাই মিথিলাদের মতো মানসিকভাবে সবল নারী নয়।
ফেনীর নুসরাত মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা যৌননিপীড়ন, অতঃপর হত্যার শিকার হয়েছিল, সেখানেও ঐ পুরুষ শিক্ষকের বদলে কেউ কেউ নাক ডুবিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছিল— দেখিতো মেয়েটির দোষ আছে কি-না! ২০২১-এ অভিনেত্রী শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি এক পুরুষ কর্তৃক যৌনহয়রানির অভিযোগ তুলেছিল। অনেকে বলেছিল— ‘অত রাতে মেয়ে মানুষের আবার বাইরে গেল কেন!’ কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি, অত রাতে ঐ মধ্যবয়সী পুরুষটা কী কারণে-কী আশায় ঐখানে ছিলেন! আবার কেউ কেউ কটাক্ষ করে এটাও বলেছিল— ‘পরীমনি বেপর্দা-বেগানা নারী, এমনটা হওয়ায় স্বাভাবিক।’ অথচ প্রতিনিয়ত যে দেশের ধর্মশালাগুলোতে ছোটো-ছোটো পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করে পশ্চাৎদেশের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এসব নিয়ে আবেগমারানীদের টুঁ-শব্দটি নেই। ওসব শিশুদেরও কি পর্দা করার কথা ছিলো? বিপরীতে, আপনি বলতে গেলেই বেকায়দায় পড়ে যাবেন। আপনাকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দেওয়া হবে।
তাহসানরা বারবার বেঁচে যান পুরুষ হওয়ায়। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য ব্যক্তি তাহসান বা পুরুষ সমাজকে হেয় করা নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা। এ সমাজে পচন ধরেছে বহু আগে। আশার বাতি যেটুকু জ্বলছে, সেটুকুও কখন নিভে যাবে। সভ্য ও সহনশীলতা আমি এ জাতির কাছ থেকে আর আশা করিনা, কেননা তা দিনকে-দিন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। আমার এ জাতি আগামী শান্তিপূর্ণ বিশ্বের জন্য একটা বিশাল বড়ো হুমকি।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী
সারাবাংলা/এএসজি