নারীদের ভিক্টিম ব্লেমিং: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০১
নারী নিপীড়নের অভিযোগ করা নারীরা সমাজে নানা ধরনের ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের (ভুক্তভোগীকেই দায়ী করা) শিকার হন। এ প্রবণতা নারী অধিকার ও ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় বাধা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতি এবং শিক্ষার অভাব এ সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলেছে।
ভিক্টিম ব্লেমিং: একটি প্রথাগত চিত্র
ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের একটি বড় দিক হলো পোশাক বা চালচলন নিয়ে মন্তব্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে দুই পরিবেশেই নিপীড়নের শিকার নারীদের প্রায়ই বলা হয়, ‘অশালীন’ পোশাক বা ‘উসকানিমূলক আচরণ’ নিপীড়নের কারণ। অথচ গবেষণা প্রমাণ করে, পোশাক বা আচার-আচরণ নিপীড়নের কোনো কারণ নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন ঘটনাও দেখা গেছে যেখানে বোরকা বা হিজাব পরিহিত নারীও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
চরিত্রের ওপর আক্রমণ
ভুক্তভোগী নারীদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলাও বাংলাদেশে একটি প্রচলিত সমস্যা। অনেক সময় বলা হয়, নারীর অতীত সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত জীবন নিপীড়নের ‘কারণ’ হতে পারে। এটি শুধুমাত্র নারীর প্রতি অবিচার নয়, বরং তাদের সামাজিকভাবে হেয় করার একটি কৌশল। এ প্রবণতা ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচারের পথকে আরও কঠিন করে তোলে।
মিথ্যা অভিযোগের ধারণা
বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে নারীরা প্রায়ই মিথ্যা অভিযোগ করে পুরুষদের হেয় করতে চান। বাস্তবে, মিথ্যা অভিযোগের হার অত্যন্ত কম। ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে নিপীড়নের ঘটনাগুলোর অধিকাংশই প্রমাণিত হয়, কিন্তু ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের ফলে অনেক নারী ন্যায়বিচার পাওয়ার আগেই থেমে যান।
সামাজিক চাপ ও মানসিক অত্যাচার
ভুক্তভোগী নারীরা প্রায়ই সামাজিক ও পারিবারিক চাপের মুখোমুখি হন। পরিবার থেকে অনেক সময় অভিযোগ তুলতে নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ এটি ‘পরিবারের সম্মান’ নষ্ট করতে পারে। সমাজে নারীর প্রতি এই বৈরী মনোভাব অপরাধীদের আরও সাহসী করে তোলে।
বিচারব্যবস্থায় অবহেলা
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় নারী নিপীড়নের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেয় না। নারীদের থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে গেলে নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং আরও তীব্র হয়।
বাংলাদেশে ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের কারণসমূহ —
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। এই মানসিকতা নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ এবং পুরুষের আচরণকে প্রায়শই অপ্রশ্নিত রাখা হয়।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতির নামে নারীর ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দকে দোষারোপ করা হয়। এটি শুধু নারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম নয়, বরং ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়।
অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব
অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের অন্যতম কারণ। অনেক মানুষ জানেন না যে ভিক্টিম ব্লেমিং একটি অপরাধ এবং এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ফলে এই প্রবণতা সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে।
মিডিয়া ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি
বাংলাদেশের টেলিভিশন ও সিনেমায় নারীকে প্রায়শই ভিকটিম ব্লেমিংয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। ‘নারীর শালীনতা রক্ষা’ বা ‘পরিবারের সম্মান’ রক্ষার নামে এই সংস্কৃতি আরও প্রসারিত হয়।
ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের প্রভাব কি হতে পারে?
ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া
ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো নারীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। অভিযোগ তুলতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে অনেক অপরাধী দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
ভিক্টিম ব্লেমিং ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দোষারোপের কারণে অনেক নারী বিষণ্ণতা, আত্মসম্মানহীনতা ও ট্রমার শিকার হন।
অপরাধীদের সুরক্ষা
ভিক্টিম ব্লেমিং অপরাধীদের জন্য একটি সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে। যখন ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা হয়, তখন অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়।
সমাধানের পথ যা হতে পারে —
জনসচেতনতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশে ভিক্টিম ব্লেমিং বন্ধ করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ
নারীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন এবং ভিক্টিম ব্লেমিং রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন
শিক্ষাব্যবস্থায় নারী অধিকার ও সমতার বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। শিশুদের ছোটবেলা থেকে নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো উচিত।
মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা
মিডিয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানজনক চিত্র উপস্থাপন করতে হবে। টেলিভিশন ও সিনেমায় ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের প্রচলন বন্ধ করা উচিত।
ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো
ভিক্টিম ব্লেমিং বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেওয়া এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত।
নারী নিপীড়নের শিকার নারীদের ভিক্টিম ব্লেমিং বন্ধ করা শুধু নারীর অধিকার নয়, এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত। ভিক্টিম ব্লেমিং মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় উদাহরণ, যা সমাজের অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশে এ সমস্যা সমাধানে দরকার জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই প্রবণতা বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এএসজি