Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন বাংলাদেশ: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অনন্য

ড. মো. রেজাউল করিম
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২৩

জুলাই বিপ্লবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল। ছবি: খুবি জনসংযোগ শাখা

নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। ’২৪ এর জুলাইয়ে ছাত্রদের হাত ধরে এসেছে এই বাংলাদেশ। নতুন করে লিখিত হয়েছে দেশের ইতিহাস। এ বছর জুনে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান; এ যেন একের পর এক তারুণ্যদীপ্ত দ্রোহ এবং শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাণিত আঘাত, যা স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের মানুষকে দিয়েছে নবমুক্তির বার্তা। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু ’২৪ এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবে অর্জিত বাংলাদেশ হলো বাক স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, আত্মত্যাগ এবং শহিদি মৃত্যুবরণের মাধ্যমে অর্জিত এই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এ বছর জুন মাস থেকে। ৫ জুন বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে জারিকৃত কোটা সংস্কার বিষয়ক একটি সরকারি পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। এ রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী রায়টির বিরোধিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করে এবং রায়টি বাতিলের দাবি জানায়। ধীরে ধীরে ছাত্রদের জমায়েত আরও বৃদ্ধি পায় এবং একপর্যায়ে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সভা-সমাবেশ শুরু হয়। কিন্তু সরকার ও উচ্চ আদালত শিক্ষার্থীদের এই ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করতে থাকে। ১৪ জুলাই পতিত স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের রাজাকারের ‘নাতিপুতি’র সঙ্গে তুলনা করেন। তার এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের ভীষণভাবে আহত করে এবং তারা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। সেদিন মধ্যরাতেই তারা শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারী শাসক আখ্যা দেয়।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশকে আওয়ামী শাসক গোষ্ঠি এবং তাদের ছাত্র নামধারী সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। তারা সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ করে। সেই সঙ্গে আওয়ামী দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়া পুলিশ বাহিনীও ছাত্রনীপিড়নে অংশ নেয়। জুলাইয়ের ১৬ তারিখে সারা দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়, যা পরবর্তী দুই দিন অব্যাহত থাকে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় কয়েকশ’ শিক্ষার্থী, আহত হয় সহস্রাধিক মেধাবী তরুণ। দেশব্যাপী এই সংঘর্ষে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত ডিসিপ্লিনের গ্রাজুয়েট ও বিইউপির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস) ছাত্র মুগ্ধসহ অসংখ্য শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, যা সাধারণ জনগণকেও ব্যথিত, হতোদ্যম এবং ক্রোধান্বিত করে তোলে। দেশের সর্বোস্তরের মানুষ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগীদের অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। জনরোষে ভীত-সন্ত্রস্ত স্বৈরাচারী সরকার আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ততদিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনকে সঠিক ধারায় রাখতে কয়েকজন ত্যাগী শিক্ষার্থী সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। তারা সকল প্রকার বৈষম্য প্রতিহত করার ডাক দেয়। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়ে ওঠে সরকার পতনের ‘এক দফা’ আন্দোলন।

ছাত্র আন্দোলনকে দুমড়ে মুচড়ে সমূলে উৎপাটন করতে ফ্যাসিস্ট সরকার তার সকল অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। কিন্তু প্রতিদিন মেধাবী শিক্ষার্থীদের করুণ মৃত্যু ও আহতদের আর্তনাদ দেশের সাধারণ জনগণ মেনে নেয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রহীন, স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত অপশাসনে মানুষ ছিল তিতিবিরক্ত। সবকিছুর মিশেলে ছাত্র ও জনতার লক্ষ্য এক হয়ে যায়। জুলাই আন্দোলনের গতিশীলতাকে ধরে রাখতে ছাত্ররা আগস্ট মাসের আগমনকে বিলম্বিত করতে থাকে। একত্রিশে জুলাইয়ের পরে এক আগস্ট হলেও ছাত্ররা তা ঠেকিয়ে রেখে ছত্রিশ জুলাই পর্যন্ত নিয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় জুলাই মাস। অবশেষে ছত্রিশ জুলাই যা সাধারণভাবে ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার ঢাকামুখী লংমার্চ ও গণভবন ঘেরাওয়ের মতো অভূতপূর্ব কর্মসূচিতে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন এবং ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে আসে নতুন এই বাংলাদেশ। ছাত্ররা যার নাম দিয়েছে বাংলাদেশ ২.০ বা দ্বিতীয় বাংলাদেশ।

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনে একজন বীর শহিদ। ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সে ‘ভাই, পানি লাগবে, পানি’ বলে আন্দোলনরত ক্লান্ত-শ্রান্ত শিক্ষার্থী-জনতাকে পানি পান করাচ্ছিল। সংগতকারণেই শহিদ মীর মুগ্ধর সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত। মুগ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের ১৯ ব্যাচের ছাত্র ছিল। ক্যাম্পাসে সে ছিল খুবই পরিচিত মুখ। সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে সবার কাছেই ছিল তার গ্রহণযোগ্যতা। ছাত্র হিসেবে সে একদিকে যেমন ছিল মেধাবী, তেমনি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল সমান পারদর্শী। সদা প্রাণবন্ত মুগ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্রই যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছিল। চার বছরের স্নাতক শেষ করে সে ভর্তি হয়েছিল ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন জুলাই বিপ্লবে সে শহিদ হয়।

মুগ্ধর মৃত্যু হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ফুঁসে ওঠে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে পূর্বে কখনও এমন বিপ্লবী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়নি। মুগ্ধ ২০২৩ সালে গণিতে স্নাতক শেষ করায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠীরা এখনও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত এবং রয়েছে তার জুনিয়র ব্যাচের সকল শিক্ষার্থী। মুগ্ধর মৃত্যুর খবর শুনে তারা প্রথমে শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। তারা একত্রিত হয়ে খুলনার প্রবেশদ্বার খান জাহান আলী সেতু ও জিরো পয়েন্ট অবরোধ করে খুলনা শহরকে অচল করে দেয়। তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষে অনেকেই আহত হয়। কিন্তু তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। তারা প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট ও গল্লামারি থেকে জিরো পয়েন্ট সড়কে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যায়। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলনকে স্তিমিত করতে সরকার যখন ভয়ানক নিপীড়ন শুরু করে তখন ছাত্র আন্দোলনটি একটু থমকে গেলেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রবল প্রতিরোধ-সংগ্রাম চালিয়ে যায়। দেশের প্রতিটি মানুষের নজর ছিল সেদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘নৃশংস হত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং আন্দোলন থেকে সরে আসতে বলে, যা তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়ার কল্যাণে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বস্তরে নিন্দার ঝড় ওঠে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ সরকারি সিদ্ধান্তে আচমকা সকল হল বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার স্বৈরাচারী চেষ্টায় শামিল হয়। কিন্তু ছাত্ররা সেই নির্দেশ অমান্য করে হলেই অবস্থান করে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যায়।

বাংলাদেশে যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র ছাত্র রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। সম্পূর্ণ দলীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও খ্যাতির কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান। এখানে নেই কোনও সেশনজট। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি দিনও অকারণে নষ্ট হয় না। যেখানে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন রয়েছে এবং তাদের দ্বারা শিক্ষাজীবনের মূল্যবান সময় অপচয় হচ্ছে, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে শিক্ষায়তনের মাটি রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে; সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সারাবছরই একনিষ্ঠভাবে জ্ঞানার্জন ও গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের করা র‌্যাংকিংয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উপরের দিকে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নেই বলে এখানকার শিক্ষার্থীরা রাজনীতি সচেতন নয়, এমনটা মনে করার সুযোগ নেই। বরং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। কারণ, এখানে রয়েছে পঁয়ত্রিশটিরও বেশি সহ-শিক্ষামূলক ক্লাব ও সংগঠন। যেখানে বিতর্ক, গবেষণা, ক্যারিয়ার গঠন, গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, খেলাধুলা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনি চর্চা, ফিল্ম, ফটোগ্রাফি, সাংবাদিকতাসহ নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা চর্চা করে থাকে। এসব সংগঠনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি হয়। গণতান্ত্রিকধারায় এসব সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। ফলে গতানুগতিক ছাত্র রাজনীতিমুক্ত হলেও গণতান্ত্রিক চর্চায় নিঃসন্দেহে তারা অনেক এগিয়ে।

বিগত সরকারের আমলে দেশে যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল এবং জনগণের ওপর দমন-পীড়নমূলক নীতি চাপিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হয় ও সহ্যের বাঁধ ভেঙে ছাত্র-জনতার বিপ্লব সংগঠিত হয়; সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহ-শিক্ষামূলক সংগঠনে গণতন্ত্রের বিশুদ্ধ চর্চা হওয়ার ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা খুলনাসহ দক্ষিণবঙ্গের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলমান ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে। ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ গ্রুপ যেমন থটস, বিহাইন্ড দ্যা কেইউ প্রভৃতি এই আন্দোলনে ভীষণভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অতএব, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রদের দ্বারা নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির সম্মুখে নেতৃত্বদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান; এ কথা বলাই যায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অন্যদের থেকে ভিন্ন, সেটা হলো সকল ঝড়-ঝাপ্টা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। ৫ আগস্ট আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সারাদেশে যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সেই সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ একে একে পদত্যাগ করে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ঘটে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রারসহ সিন্ডিকেট সদস্য, হল প্রভোস্ট, বিভিন্ন দপ্তরের পরিচালক ও শাখা প্রধানরা পদত্যাগ করে। একযোগে ৬৭ জনের এমন পদত্যাগ দেশের অন্য কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি এমনকি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েই এটি প্রথমবার ঘটলো। কোনও ধরনের কর্তৃপক্ষ না থাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়। প্রশাসনিক কার্যক্রম একদম বন্ধ হয়ে যায়। জরুরি সেবাসমূহ মুখ থুবড়ে পড়ে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন ভাতাও বন্ধ হবার উপক্রম হয়। সেই অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জরুরি আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্বভার অর্পিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের ওপর। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করা হয়। ফলে এত বড় ছাত্র আন্দোলনের পরেও ছাত্ররা ক্লাসে ফিরে আসে। তারা আবার শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্নিহিত শক্তি। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ই সবার আগে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রস্তুতসহ নতুন ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শিক্ষার্র্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে তাদের বিজয় উদ্যাপনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। হলে হলে ছাত্রদের সমন্বয়ে নবীন-প্রবীণ ছাত্র সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রীতি ভোজ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবকে তুলে ধরে। শহিদ মীর মুগ্ধর স্মরণে দোয়া ও আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এছাড়াও দেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীতে কী করণীয় এবং কোন কোন সংস্কার জরুরি ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিসমূহে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেই আগামীর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে, কারণ শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরই, তারাই এনেছে নতুন সকাল। নতুন এই দেশ।

তারুণ্যকে কখনও দমিয়ে রাখা যায় না। সকল অন্যায়, মিথ্যা ও শোষণের বিরুদ্ধে চিরকাল এদেশের তরুণ যুবকেরা রুখে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও তারা সকল অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়বে। জুলাই বিপ্লবে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি বা উপদেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম সরকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কাজ করার সুযোগ এসেছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের। অতএব, বিশ্বাস রাখাই যায়, ছাত্ররা এবারও সফল হবে। দেশের প্রয়োজনীয় সংস্কারে তারা অবদান রাখবে। আগামীতে যাতে কোনও দল বা প্রতিষ্ঠান একনায়কতন্ত্রী, কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হতে না পারে সেদিকে সদাদৃষ্টি রাখবে। সর্বোপরি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেমন পথ দেখিয়েছে, তেমনিভাবে আগামীর বাংলাদেশও গড়বে নতুন প্রজন্ম।

লেখক: উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর