জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জরুরি
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৩
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আমাদের এর ব্যবহার কমাতে হবে। উন্নয়নের মডেলে পরিবর্তন আনতে হবে এবং দূষণ রোধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। উপদেষ্টা সাথে একমত পোষণ কিছু কথা যোগ করে বলা যায়, বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরনে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়, বাড়ে পৃথিবীর তাপ প্রবাহ। বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়, অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের সমুদ্র উপকূলে লবণাক্ততা বাড়ে, বাড়ে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, খাদ্য নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা। জীবাশ্ম জ্বালানী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে তিন-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। পাশাপাশি জলবায়ুর ওপর শিল্পের প্রভাব কমাতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত; তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন নয় দরকার ঐক্য। কিন্তু বাস্তবে তা লক্ষ্যণীয় হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালটি সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হওয়ার রেকর্ডের নিকটবর্তী। উত্তর আমেরিকায় চরম দাবানল দেখা গেছে। আফ্রিকায় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চীন, দক্ষিণ ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড গড়া তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলসহ ভয়াবহ হারিকেন ও ঘূর্ণিঝড়ে লিবিয়া, গ্রিস, তুরস্ক ও বুলগেরিয়ায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। সমুদ্রের তাপমাত্রাও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা প্রবালের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে এবং সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রকে ওলটপালট করে ফেলছে। বিজ্ঞান সতর্ক করে দিচ্ছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আবহাওয়ার নির্দয় আচরণ আরো বেশি বাড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে এবং জলবায়ু সংকট যেভাবে তীব্রতর হচ্ছে; বিশ্বনেতাদের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে গত ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর দুবাইতে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। সম্মেলনের আয়োজক দেশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জলবায়ু ঝুঁকি সৃষ্টিকারি জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এবারের সম্মেলনের বেশকিছু ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিল (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) চালু করতে সম্মত হয়েছেন বিশ্বনেতারা। আয়োজক দেশ সম্মেলন শুরুর দিনই এই ফান্ডে ১০০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ ১০০ বিলিয়ন অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ২০২৫ সালে ৫০০ বিলিয়নের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে চার দশমিক তিন ট্রিলিয়ন এবং ২০৫০ সাল নাগাদ পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিযোগ করার কথা। এবার অবশ্য জলবায়ু তহবিল তথা সবুজ অর্থায়ন তহবিল (জিসিএফ) এ আশাজনক অর্থ জমা পড়েছে। প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য তহবিলেও কিছু অর্থ জমা দেওয়া হয়েছে।
এবারের সম্মেলনের শুরুতেই জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ২০২৩ সাল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। এভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য পূরণ হবে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এতে ভূমিকা একেবারেই নগণ্য। ইতোমধ্যে সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের আরো ২২টি দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবহার বর্তমানের চেয়ে তিন গুণ করা হবে। ১৭৬০ সালে শুরু হওয়া প্রথম শিল্পবিপ্লবের পর মানব সভ্যতা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পৌঁছেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সত্ত্বেও শিল্পবিপ্লব থেমে থাকার উপায় নেই; বরং অচিরেই পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে যাবে উন্নত বিশ্ব। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে দ্রুতই প্রশমন এবং অভিযোজনের উদ্যোগ নিতেই হবে। প্রশমন পদক্ষেপ হিসেবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এ জন্য বিকল্প জ্বালানি যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর ও বায়বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে, কমাতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার। কার্বন শোষণের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে সবুজায়নের বিকল্প নেই। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে বসবাসকারী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে; যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও রয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই’র সম্মেলনে বিশ্বের ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের ৮৪ হাজারের বেশি প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী যোগ দিয়েছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি এবারের সম্মেলনে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ হামাস-ইসরায়েলের সংঘাত নিয়েও আলোচনা হয়। কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি আরব আমিরাতের সুলতান আল জাবের বলেছেন, ‘এখন আসল কাজ শুরু হবে। আমি নিজেই জামার আস্তিন গুটিয়ে কাজে নামব, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করব এবং বাস্তব ও কার্যকর অর্জনে ভূমিকা রাখব।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় তেল সংস্থা অ্যাডনকের প্রধান জাবের বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ভূমিকা’ অবশ্যই জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। জলবায়ু কর্মীরা এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এবং জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে বিকল্প উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের স্বনামধন্য পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত এক দশমিক ৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে একবিংশ শতাব্দী শেষে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় অর্ধশত দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে। চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার দারনা শহরে সংঘটিত বন্যা উল্লেখযোগ্য। এর ফলে অন্তত ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল হ্রদ টিটিকাকা ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে, যা হ্রদের তীরে থাকা ৩০ লাখ মানুষের জীবিকায়নে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাপী এল নিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ বছরের আগস্ট মাসকে ভারতে ১২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। জুলাই মাসে জাপানে ৫৩ জন হিটস্ট্রোকে মারা গেছে। জলবায়ুর প্রভাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই থেমে যাবে আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোত; অ্যান্টার্কটিকার পৃথিবীর বৃহত্তম বরফখণ্ড গলে ও সরে গিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে; আমাজন শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের ৮৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সহনশীল পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি এবং পরিবহন থেকে নির্গত ধোঁয়া থেকে যে দূষণ, তা রোধ করা জরুরি। এটিকে এমন একটি ব্যবস্থায় নিতে হবে, যা প্রকৃতির সঙ্গে সহনশীল। সব অংশীজনের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা আমাদের যৌথ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংকট কাটানোর একটি সুযোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই এবারের সম্মেলন থেকে ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো।
২০২৩ সালের জুনে প্যারিসে অনুষ্ঠিত নিউ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং প্যাক্টের শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে প্রাপ্তির চেয়ে তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য বেশি অর্থ প্রদানের মতো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। আরো ছাড় ও অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণ বাতিলের নিমিত্তে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও এর সহযোগী সংস্থাগুলো পুনর্গঠনের দাবি জানায়। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে, পৃথিবীর উষ্ণতা, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরন কমাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করার কোন বিকল্প নেই।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত বণিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জরুরি মুক্তমত