Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জেলহত্যার গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু বিচার আর কতদূর

ইমরান ইমন
২ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১২ | আপডেট: ৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:১৪

৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। এই দিন ইতিহাসের দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ইতিহাসের দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হলো ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর একই বছরে প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো এ হত্যাকাণ্ডেও একদল বিপথগামী সেনা সদস্য জড়িত ছিল। তারপর থেকে রাষ্ট্রের হেফাজতে কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনাটি ‘জেল হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই তখন জাতীয় এ চারজন নেতা দলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রায় আড়াই মাস পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে জাতীয় এ চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তখন অনেকটাই দিশেহারা অবস্থায়। তখন দলের চারজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকেই কারাগারে এবং অনেকে আত্মগোপনে ছিলেন। বাকি নেতারা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে সমঝোতা করেন। অনেকে আবার রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচাইতে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক সদস্য হিসেবে পরিচিত এবং তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার এ পরিকল্পনা করেন। এ কাজের জন্য তারা আগেভাগে একটি ঘাতক দলও গঠন করেন। এ দলের প্রধান ছিলেন রিসালদার মোসলেহউদ্দীন। তিনি ছিলেন ফারুকের সবচেয়ে আস্থাভাজন অফিসার। ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে যে ঘাতক দলটি হত্যাযজ্ঞ চালায় সেই দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোসলেহউদ্দীন।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ: অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড’ (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ) গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরেই জেল খানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেওয়া হয়েছিল পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যাতে আপনাআপনি এটি কার্যকর হয়। আর এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয়। এই ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোর পরেই কেন্দ্রীয় কারাগারে এই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতির পিতাকে তার ঐতিহাসিক ধানমন্ডি-৩২ এর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। পরে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের সমধিক পরিচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কোটি কোটি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখেন।

বঙ্গবন্ধুর অপর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এএইচএম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, খন্দকার মোশতাক জেল হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন কেবল ফারুক আর রশিদকে নিয়ে। তিনি ঠিক করেছিলেন যে, যে কোনো পাল্টা অভ্যুত্থান হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হবে। যাতে নতুন সরকার গঠিত হলেও এই নেতারা তাতে নেতৃত্ব দিতে না পারেন।

অন্যদিকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্য এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল লন্ডনে। এসব হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে যে সমস্ত কারণ বাধাগ্রস্ত করেছে সেগুলোর তদন্ত করার জন্য ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তবে সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের অসহযোগিতার কারণে এবং কমিশনের একজন সদস্যকে ভিসা প্রদান না করায় এ উদ্যোগটি সফল হতে পারেনি।

জেল হত্যার পরদিন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। জেলহত্যার দীর্ঘ ২১ বছর এ বিচার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোঃ মতিউর রহমান মামলায় রায় দেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চার আসামি সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে দেওয়া রায়ে মোসলেমউদ্দীনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাসেম মৃধাকে খালাস দেওয়া হয়। জেল হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ৩০ বছর পর জেলহত্যার বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবার এ রায়কে মেনে নেয়নি৷ তারা এ রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায়’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে সে রায়ে দণ্ডিত ১১ আসামির সবাই এখন পর্যন্ত পলাতক। অর্থাৎ, জেলহত্যা ঘটনার ৪৮ বছর পরও দণ্ডিত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিলো বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন সেই চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জেলহত্যা দিবস বাঙালির জাতীয় জীবনে এক কলঙ্কজনক ও নিকৃষ্টতম ঘটনা। এই কলঙ্কের দাগ কোনদিনও মুছবে না। আমরা এদেশের মাটিতে আর এমন কলঙ্কজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। জেলহত্যা ঘটনার রায়কে জাতীয় চার নেতার পরিবার মেনে নেয়নি। এবং যে রায়টি হয়েছিল সেখানে দণ্ডিত আসামিরাও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা চাই এ ঘটনার পুনরায় সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাক। এদেশের আপামর জনতার পক্ষ থেকে জাতীয় চার নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন জেলহত্যার গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু বিচার আর কতদূর মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানল, নিহত ৫
৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর