Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নববর্ষের বাঙালিয়ানা ও সমৃদ্ধি

অনন্য প্রতীক রাউত
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৫৮

১৪৩০ এর আগমন ঘটলো বাংলার বুকে। বাংলা নববর্ষে বাঙালির জন্য নবসূচনা এটা সবসময়ই মনে করা হয়৷ বাঙালিয়ানাকে সঙ্গী করেই মূলত এ দিনের কর্মকাণ্ড রচিত হয় নতুন মাত্রায়। প্রতিটি মানুষই চায় নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাকে নিজেকে রাঙিয়ে মুখে পান্তা-ইলিশ-পোড়া মরিচের তৃপ্তিময় ঢেকুর তুলতে। দুর্ভাগ্যবশত, এতে করেই বাঙালিয়ানা হয়ে গেছে দিনকেন্দ্রিক বেড়াজালে বন্দী। কেননা, অন্য দিনগুলোতে আমরা হয়ে যাই তথাকথিত আধুনিকতার দাস, সময়ের প্রয়োজনে নিজ অস্তিত্বকে করি বিনাশ।

বিজ্ঞাপন

বাঙালিয়ানা, বাঙালি সংস্কৃতি নববর্ষের মূল উপজীব্য বিষয় হলেও আজকাল এসব হারিয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি। এখন আমরা তথাকথিত উন্নত সংস্কৃতি তথা পশ্চিমা দেশগুলোর কালচারে বেশী আকৃষ্ট হয়ে সেদিকে ঝুঁকে পড়ছি। অথচ একসময় বাঙালি নিজেই সমৃদ্ধ ছিল নিজস্বতায়।

সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি যতই বাংলায় হানা দিয়েছে, ততই দেখেছে ব্যবসায়িক সাফল্য। আমাদের অসতর্কতা, বিভিন্ন শাসকবর্গের অদূরদর্শিতা এবং ভীরুতার জন্য বারবারই সুযোগ পেয়েছে পর্তুগিজ থেকে ব্রিটিশরা। সুযোগগুলো লুফে নিতেও বিন্দুমাত্র ভুল করে না তারা কেউ। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কিংবা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তাই ছিল বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। নিজ অস্তিত্ব বা সংস্কৃতির দিকে ঝোঁকা তো দূরে থাক, বরং আমরা আরও তাদের দেখানো পথে ‘তোতাপাখির’ ন্যায় চলতে শুরু করেছি।

ফলে সহজেই আজকের অবস্থা দৃশ্যায়িত হয়েছে। আমরা যদি বর্তমানের অন্যতম পরাশক্তি চীনের কথা ভাবি দেখুন, তাদের এবং আমাদের ইতিহাসে বা সম্পদের সমৃদ্ধির দিক থেকে খুব একটা পার্থক্য নেই। উপনিবেশের কবলে থাকলেও তারা নিজ সংস্কৃতি এবং কর্মক্ষমতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এক প্রকারের জেদ তাদের নিয়ে গেছে অসীম এক উচ্চতায়। অথচ, আমাদের অবস্থা দেখুন! দিন দিন পরিণত হচ্ছি তথাকথিত আধুনিকতার দাস হিসেবে। আধুনিকতার প্রয়োজন অবশ্যই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে তবে সেটার অর্থ নিজ অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া নয়!

ইতিহাসের নিরিখে দেখার পর এবার একটু বর্তমান বাস্তবতায় দেখি আসুন। এখনকার সময় পয়লা বৈশাখ এবং পরবর্তী সময়ের বাঙালিয়ানার সমস্যা আসলে কোথায়? মূলত আমরা দিনকেন্দ্রিক বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডে অভ্যস্ত। সংশ্লিষ্ট দিনে অতিমাত্রায় থাকে আবেগ। দিনের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আচরণ হয় ভিন্ন, বিশেষ দিনটিকে বিশেষভাবে দেখার পর যাই চিরচেনা রূপে ফিরে। ঘোরাঘুরি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা উপভোগ বেশ প্রথাগতভাবেই হয়ে আসছে আমাদের প্রতিটি নববর্ষে। সবার দিনলিপিতে খুব একটা ভিন্নতা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু, ঠিক ১৫ এপ্রিল থেকেই দৃশ্যপট যায় বদলে। স্যুটেড-বুটেড হয়ে অফিস যাওয়া, কফির কাপে চুমুক, চায়নিজের স্বাদে নিজেকে আধুনিক ভাবা রক্তে মিশে যায় অজান্তেই। আবার উদ্ভব ঘটে বৈশাখকে নানাভাবে জাস্টিফাই করবার অহেতুক তত্ত্বগুলো। পৃথিবীতে বাঙালিরাই হয়তো একমাত্র জাতি যারা নিজ সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন এবং একটা বিশাল অংশের মানুষ সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততাকে সোজাসুজি অস্বীকার করে বসে। সরাসরি বিরুদ্ধে কথা বলে।

বিজ্ঞাপন

বিরুদ্ধে তর্ক করে থাকে দু’শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ। যার মধ্যে একটি পক্ষ অতিমাত্রায় আধুনিক অন্যদিকে আরেকটি পক্ষ একেবারেই ধর্মান্ধ। এই দুইয়ের চাপে বাঙালিয়ানা আজ পুরোপুরি স্যান্ড উইচের মতো অবস্থায় চলে গিয়েছে।

ফলশ্রুতিতে, সাংস্কৃতিক বাস্তবতাতেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ‘এসো হে বৈশাখের’ জায়গা দখল করে নেয়, ‘মেরি জান উসকো পাগল হুগায়ি ’-এর মতো হিন্দি গান। আজকাল বাংলা সিনেমা বা কিছু বিশেষ নাটক বাদ দিলে তেমন একটা ভালো নির্মাণ দেখা যায় না। তরুণ প্রজন্ম তাই বিনোদনের খোরাক মেটাতে অনায়াসে ঝুঁকে ভিনদেশি সংস্কৃতিতে।

যদিও আজকাল বাংলাদেশী অনেক ওয়েব সিরিজ ওটিপি প্লার্টফর্মগুলোতে বেশ আলোড়ন তুলেছে। ফলাফল টাও ভোগ করে জাতি সরাসরি। নানা দুরবস্থা হয় তরুণদের সঙ্গী। কেননা, সমাজব্যবস্থার ভিন্নাবস্থা হুট করেই তো অন্য ভিন্নধর্মী সমাজে প্রয়োগ করা যায় না। ফলে সৃষ্টি হয় পূর্ববতী প্রজন্মের সঙ্গে নানা মানসিক দূরত্ব। এমনকি নির্মাতারাও তরুণ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের তথাকথিত নির্মাণে।

জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে স্বভাবতই তারা নানা অশ্লীল, ভিন্নমাত্রার দৃশ্য যুক্ত করে দেন তথাকথিত ওয়েব সিরিজ বা নাটকে। এমনকি, চরিত্রগুলোর পোশাকেও থাকে ভিন্নধারার সাংস্কৃতিক প্রভাব। এক প্রজন্মের কাছে যা হয় রোমাঞ্চকর, অন্যদিকে পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে তা হয়ে ওঠে অসহনীয়। এমতাবস্থায় প্রাজন্মিক দূরত্ব বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব দুরবস্থা অনেক বড় বড় অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। পত্রপত্রিকা ও নানা সমীক্ষায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, শিশু-কিশোরদের অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এটা অবশ্যই ভয়াবহ বিষয়। লাগাম টেনে এখনই না ধরলে এর দায় কে নেবে?

অনেকে বলবেন, তবে কি বাংলাদেশকে উত্তর কোরিয়ার মতো বানানো উচিত? কখনোই না ভাই। অন্য সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে কেউ বলছে না বরং নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীনতার কথা বলছে মাত্র। ভিন্ন ধারার সংস্কৃতিকে ঘৃণা করলেই নিজ সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে না। নিজ সংস্কৃতি রক্ষায় যেমন হতে হবে সচেতন, তেমনি জানার স্বার্থে অন্য সংস্কৃতির আবহে ঘোরাফেরা করা যেতেই পারে তবে মাতোয়ারা কখনোই নয়। তাই সংস্কৃতিকেন্দ্রিক সচেতনতা গড়ে তোলার সময় এখনই। যেহেতু বিনোদনমাধ্যম সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আনয়নে ভূমিকা রাখে সবচেয়ে বেশি, তাই নির্মাণের সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য নির্মাতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। অতিমুনাফা বা অসতর্কতায় তাঁরা যেভাবে আগামী প্রজন্মকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করছেন, তা সত্যিই আমাদের জন্য লজ্জাজনক। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো যায়, এমন নির্মাণ নিয়ে জোরশোরে কথা হচ্ছে। তাই, দর্শকদের এ চাহিদার দিকে তাঁদের নজর দেওয়া উচিত নয় কি? এসবের ওপর একটি প্রজন্মের আগামীর সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধ রোধ করতে মানবিক মানসিকতা তৈরি করা খুব জরুরি৷ নিজ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চা কি হবে শুরু তবে এ বৈশাখ থেকেই?

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজ স্বার্থে যেমন আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে, তেমনি দেশীয় অপশক্তির দায়টাও কম দিলে হবে না। বিশেষত পাকিস্তান আমল থেকে তা অব্যাহত আজও। নানা স্পর্শকাতর বিষয়কে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ নববর্ষকেন্দ্রিক নেতিবাচক তকমা লাগিয়ে চলেছে অবিরাম। অসচেতনতায় ভিন্ন স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া লোকদের দায় যেমন আছে, তেমনি এদের তো বড় দায়। এদের বিরুদ্ধেও বসে থাকলে চলবে না। বড় মাত্রার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে হবে এবং অবশ্যই সংস্কৃতিকেন্দ্রিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।

সর্বোপরি, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে এখনই সময় উঠে দাঁড়াবার। নয়তো দিনকেন্দিক এ নববর্ষও একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়। সুতরাং, ষোলোআনা বাঙালিয়ানার বিকল্প কোথায়? তবে এর মানে কখনোই আধুনিকতাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। প্রয়োজন দুদিককার বাস্তবিক বা সময়োপযোগী এক মিশেল। নতুন বছরের শুভেচ্ছা, সমৃদ্ধি আসুক বাঙালির প্রতিটি পদক্ষেপে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অনন্য প্রতীক রাউত নববর্ষের বাঙালিয়ানা ও সমৃদ্ধি মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানল, নিহত ৫
৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর