সাংবাদিকতায় এবিএম মূসা পাঠ জরুরি কেন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৭
এবিএম মূসা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংবাদিক সমাজের কাছে অনন্ত প্রেরণার বাতিঘর। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও সুসাংবাদিকতার মাধ্যমে এদেশের গণমাধ্যমকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এবিএম মূসা। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সম্পাদক ও কলামিস্ট। ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মহান মানুষটির জন্মদিবস। বরেণ্য সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি একই জেলার পাশের উপজেলা ফুলগাজীর কুতুবপুর গ্রামে। এবিএম মূসার পৈতৃক বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। কিছুদিন আগেও তার বাড়িতে গিয়েছি তাকে নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে।
এ বছর এবিএম মূসার ৯২তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। এবিএম মূসার শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কুল, নোয়াখালী জিলা স্কুল, ফেনী সরকারি কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। বিএ প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েছেন চৌমুহনী কলেজ থেকে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি খুব অল্প বয়সেই। কলেজে থাকাকালীন সময়ে ১৯৫০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে দৈনিক ইনসাফের মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন তিনি। একই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার, স্পোর্টস রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ করে দিলে তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এ যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আবার দৈনিক অবজারভারে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে এবিএম মূসা রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠানোর কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাব্যবস্থাপক, ‘দ্য মর্নিং নিউজ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে এবিএম মূসা নিজ জেলা ফেনী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অবস্থিত জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের (এসকাপ) এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। এরপর দেশে ফিরে এসে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য দৈনিক যুগান্তর-এ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসা জাতীয় প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠা সদস্য ও আজীবন সদস্য। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের চারবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সাংবাদিকতার জগতে এবিএম মূসার পদার্পণ প্রসঙ্গে সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ার উল্লেখ করেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা শুরুর আগেই গান্ধিদর্শনের মধ্য দিয়ে তার সংবাদে হাতেখড়ি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে গান্ধি যখন নোয়াখালী আসেন, দশ মাইল পথ হেঁটে তাকে এক নজর দেখতে গিয়েছিলেন এবিএম মূসা। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। গান্ধিকে দেখার পর আবারও দশ মাইল পথ হেঁটে বাড়িফেরা। ফিরে এসে কৌতূহলী পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছে গান্ধির খবর-পরিবেশন থেকেই তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি’।
স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে এবিএম মূসা ছিলেন গুরুজনতুল্য। তার নিউজ সেন্স ছিল সব নিউজ এডিটরের মধ্যে সেরা। পেইজ মেকআপ করার সময়ে তিনি বলে দিতেন কোন নিউজটা লিড হবে, কোনটা সেকেন্ড, কোনটা থার্ড লিড, কোথায় কোন ছবি ব্যবহার করতে হবে।
প্রথম দিকে রাজনীতি করার প্রতি এবিএম মূসা ইচ্ছে পোষণ করেননি। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য যখন তাকে বলা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কোনো দিন দেশ স্বাধীন হয়, তবেই নির্বাচনে দাঁড়াব—এখন নয়’। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে আসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে নিজ জেলা ফেনী আসন থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের একজন সদস্য তথা আইন প্রণেতা নির্বাচিত হন। আবার ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক রুপরেখা পরিবর্তনের পর তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় হননি।
কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসা জীবদ্দশায় কিছু অসাধারণ কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে হলো—গাড়িতে নম্বর প্লেট বসানোর রীতি ও সংবাদপত্রের আধুনিকায়ন। এদেশে গাড়িতে যে নম্বর প্লেট এটি এবিএম মূসা-ই প্রচলন করেছিলেন। সংবাদপত্রের বর্তমান যে গেটআপ–মেকআপের পরিবর্তন, আধিক্যতা, সৌন্দর্য ও কারুকাজ এসেছে—এ সবই তিনিই করেছিলেন।
আপোসহীন কন্ঠে সরকারের নিমোর্হ সমালোচনায় এবিএম মূসা ছিলেন নির্ভীক ও সোচ্চার। তার লেখনী ছিল ক্ষুরধার। তিনি আমৃত্যু সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। মৃত্যুর পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বুড়ো বয়সেও তিনি টেলিভিশন টক-শোতে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। যা বর্তমান সময়ে বিরল। বর্তমানে তথাকথিত সাংবাদিকদের বেশিরভাগই ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের পা চাটাচাটিতেই নিমগ্ন।
সুসাংবাদিকতা, আপোসহীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা এবিএম মূসাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। সাংবাদিকতায় জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসা একজন সফল মানুষ এবিএম মূসা। খুব কম মানুষই এ অবস্থানে যেতে পারেন। এ পেশায় সত্য কথা বলতে অনেকেই ভয় পান, কিন্তু তিনি ভয় পাননি। তিনি সাহসের সঙ্গে অকপটে সত্যকে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখতেন। সাহসিকতার পাশাপাশি তার কথা, কাজ ও লেখনীতে মানবিক দিকও ফুটে উঠতো। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি আদর্শচ্যুত হননি, নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন অটল।
এবিএম মূসা দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে এদেশের সাংবাদিকতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এবিএম মূসা বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে একুশে পদক (১৯৯৯), জেফারসন ফেলোশিপ (১৯৭০), কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়ন ফেলোশিপ (১৯৬১)। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন অতিবাহিত করার পর ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সে এবিএম মূসার জীবনাবসান ঘটে। তার মৃত্যু পরবতী সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় ‘এবিএম মূসা ছিলেন আমাদের সাংবাদিক সমাজের জ্যেষ্ঠতম সদস্য ও অভিভাবক’।
এবিএম মূসা বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক প্রেরণার নাম—এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জাতির সঙ্কটকালে তিনি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের সাংবাদিকতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আপোসহীন সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র তিনি ধারণ করেছিলেন।
গণমাধ্যম বা সংবাদপত্র হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, জাতির বিবেক। একটি রাষ্ট্রের উন্নতি অগ্রগতিতে গণমাধ্যমের অবদান অপরিসীম। আর এর জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের সৎ, সাহসী ও আদর্শবান হতে হবে। সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড বিকিয়ে চাঁদাবাজি, দালালি, তদবিরবানিজ্য ও কোনো দল-মতের পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। আপোসহীন থাকতে হবে, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। যা আমাদের এবিএম মূসা পারতেন। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সাংবাদিকদের এবিএম মূসা সম্পর্কে জানতে হবে, পাঠ করতে হবে তার সংগ্রামমুখর কর্মময় জীবন।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই