Wednesday 01 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বরং জামায়াতে ইসলাম প্রকাশ্যেই আসুক!


৪ মে ২০২০ ২০:৪৯

যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক প্রবাসে বসে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে আমরা ভুলিনি এই রাজ্জাক যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বিগত সময়ে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছিলন?

বিগত সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, জামায়াতের কলকাঠি এখনো পাকিস্তানে। রাজ্জাকের পদত্যাগ যে নতুন মোড়কে পুরনো জামায়াতকে বাঁচানোর পাকিস্তানি প্রেসক্রিপশন, সেটাও দিনে দিনে স্পষ্ট হবে বলে মনে করি।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর ‘সংস্কারপন্থিরা’ নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের এক বছর পর ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।

গত শনিবার সকালে বিজয় নগরে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করেন এক বছর আগে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে গঠিত প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু।

নতুন দলের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে।

এ দলে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু কমিটির সদস্য সচিব।

সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জু বলেন, ‘‘সমালোচকদের তীর্ষক ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমাদের দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’(এবি পার্টি)।

যে নামটি এসেছে রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমের একটি বই থেকে। অনেকের ধারণা, জামায়াতের সম্পদ ও নেতাকর্মীদের নতুন আশ্রয় হবে এই সংগঠন। এই মহামারী আর সঙ্কটে জামায়াত ফেরত নেতাদের এমন ধৃষ্টতা আওয়ামী লীগ সরকারকে লজ্জায় ফেলতে না পারলেও তরুণ প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করেছে।

বিজ্ঞাপন

সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এছাড়া একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয় বলে মত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মত দিয়েছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। গোলাম আযমের আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এএইচএম কামরুজ্জামানের মামলার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। ‘গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে’।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই একই ধরনের ভূমিকাই ছিলো গোলাম আযমের। জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে। ‘স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়’।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শহিদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন বলে কোনো প্রমাণ জাতির সামনে নেই। রায়ে বলা হয়, ‘একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসেবে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়’। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে রায়ে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে। তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি রায়েই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাণ্ড ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন। একে যে বৈধতা দেয়া হয়েছে সেটা প্রথমবারও ছিলো অবৈধ, দ্বিতীয়বারও তাই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর থেকে দেশজুড়ে অনেকদিন জামায়াতের সহিংসতা চলেছে। তারা আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দিতে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত হত্যা করেছে।

বারবার বলে এসেছি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না।

বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখতে পাবো, যেসব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিলো, সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হযেছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়েছে হিজবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন। জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আল কায়েদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াত কেন নয়?

কিন্তু সত্য হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রায় প্রতিটি রায়ের পর্যবেক্ষণেই জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে উল্লেখ করলেও দলটি নিষিদ্ধে উদ্যোগ নেই সরকারের।

দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াত ও তার সব সহযোগী সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা প্রায় ৫ বছরেও মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। সবার কাছে পরিষ্কার প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার নামে টালবাহানা করছে।

তাই এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি, একজন গণজাগরণের কর্মি হিসেবে আমার চাওয়া- রাজাকারের বাচ্চারা প্রকাশ্যে আসুক। জানি, বিগত ১২ বছরে যে পরিমান জামায়াতে ইসলাম, শিবির ও স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের স্বপ্নের বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছে যা আর পূরণ হবার নয়। বিএনপির সাথে থেকেও তারা রাষ্ট্রের এতটা ক্ষতি করতে পারেনি। তাই গোপনে না থেকে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রকাশ্যে আসাই আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো। কারণ তারা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে। এমন সময় তাদের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা যা আমাদের নতুন করে ভাবনার খোরাক যোগায়, কে বা কারা শক্তি দিচ্ছে তাদের, করছে সহযোগিতা? এ খেলায় কারা জড়িত? উত্তর জানা খুব জরুরী।

বিএনপি, জাতীয় পার্টির ঘাড়ে পা দিয়ে অবস্থান তৈরি করা এই সন্ত্রাসি সংগঠন আজ তলে তলে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চেপে বসেছে। আওয়ামী লীগের ভোগ, উপভোগ আর সম্ভোগে ব্যস্ত থাকা নেতারা আজ তাদের কাছে বন্দী। ২০১৩ সালের গণজাগরণের সফলতা ঘরে তুলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকলেও গণজাগরণ যোদ্ধাদের সকল দাবীকে তুচ্ছ করে জামায়াতে-ইসলামকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং তাদের দলে ও সরকারে পদ পদবী দিয়ে, চাকরি, ব্যবসা দিয়ে এবং রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পতাকা বিক্রি করে তাদেরকে নব্যরুপে পুনর্বাসন করেছে।

যেহেতু এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সরকার বা আওয়ামী লীগের ইচ্ছে নেই, তাই বলবো যে নামেই আসুক না কেন স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শের কর্মিদের প্রকাশ্যে আসতে দেয়া হোক। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান এই প্রজন্মের সকলে তাদের চিনতে পারবে। পাকি আদর্শে জন্ম নেয়া নব্য রাজাকারদের জানতে পারবে তারা। এবং পূর্বপুরুষের রক্তাক্ত লড়াইয়ের গৌরব নিয়ে আগামীর জন্য প্রস্তুত হবে।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ; সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১; সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ

বিজ্ঞাপন

ফিরে দেখা ২০২৪ / ছবিতে বছর ভ্রমণ
১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪৫

আরো

সম্পর্কিত খবর