কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব; ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম জনস্বার্থ
৩ মে ২০২০ ২১:২৩
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আমাদের জীবনে কেবল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবেই গুরুতর প্রভাব ফেলেনি বরং এই মারাত্মক মহামারির আইনি ক্ষেত্রেও রয়েছে গভীর প্রভাব।
প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ এর ছড়িয়ে যাওয়া রুখতে দুনিয়াজুড়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা ঘিরে কিছু কৌতূহল উদ্দীপক আইনি প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। যেমন- ব্যক্তি স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকের নিজে দেশে পুনরায় প্রবেশের অধিকার বা সেসবের বিনিময়ে বৃহত্তর মঙ্গল নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
ইতোমধ্যে নাগরিকদের এসব মৌলিক অধিকারের কয়েকটি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সমগ্র পৃথিবীতেই সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনের পাশাপাশি হোম কোয়ারেনটাইনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং যার ফলে নাগরিকদের কিছু আইনি অধিকার যেমন- স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সেসব বিধি-নিষেধ মেনে চলার জন্য ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে প্রণীত সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনানুসারে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে।
এই ধরনের মহামারি রূপে আবির্ভূত হওয়া নভেল করোনাভাইরাসের সাথে অনেকগুলো আইনি প্রশ্ন জড়িত থাকলেও দেশব্যাপী যেহেতু কোয়ারেনটাইন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। দেখা গেছে অনেকেই কোয়ারেন্টাইন না মেনে যথেচ্ছা ঘোরাফেরা করছেন, এমনকি করোনা হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে না যেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে যার যার বাড়ি ফিরে গেছেন। এই ধরণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই কোয়ারেন্টাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত নাগরিক অধিকারগুলো নিয়ে কিছু সঙ্গত আলোচনা থাকবে।
কোয়ারেন্টাইন বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে কোন ব্যক্তি সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত অপর কোন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে বা রোগাক্রান্ত কোন এলাকা থেকে ফিরলে ওই ব্যক্তিও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সকলের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে রাখা।
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, আপাতভাবে কোন ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যবান মনে হলেও বা তার ভেতর কোন উপসর্গ না থাকলেও এরূপক্ষেত্রে তাকে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। কারণ আপাত উপসর্গহীন ব্যক্তিও ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে এবং উপসর্গ প্রকাশ পেতে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
কোয়ারেন্টাইন শব্দের উৎপত্তি ইতালিয়ান শব্দ ‘কোয়ারেনটাইন গিরোনি’ থেকে; যার অর্থ চল্লিশ দিন। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ইতালির ভেনিস বন্দরে প্লেগ রোগাক্রান্ত এলাকা থেকে কোন জাহাজ আসলে তাকে চল্লিশ দিনের পূর্বে তীরে ভিড়তে দেয়া হতো না; সেখান থেকেই মূলত ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের প্রচলন। কোয়ারেন্টাইনের উদ্ভবের সঙ্গেই এর সাথে যুগ যুগ ধরে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধ চলমান।
বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর ৫(১) উপধারা অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেবলমাত্র সংক্রামক রোগে আক্রান্ত সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনের আদেশ দিতে পারে। কিন্তু এই সন্দেহ কি স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে নাকি উপসর্গ দেখে নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। আইনে শুধু রোগে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহের কথা বলা হয়েছে, রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা বা ব্যাধিগ্রস্ত কোন এলাকা থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সুতরাং বর্তমান আইনানুযায়ী আপাতভাবে স্বাস্থ্যবান কোন ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মানব শরীরে প্রকাশ পেতে বা উপসর্গ প্রকাশ পেতে চৌদ্দ বা ততোধিক দিন সময় লাগতে পারে। কাজেই জনস্বার্থে এরকম ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হলে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
তবে কেউ কোনো ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত এরকম বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকলে তাকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া যেতে পারে এবং সে যেতে না চাইলে বা আদেশ অমান্য করলে আমল অযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য অপরাধ সংগঠন করেছে বলে প্রতীয়মান হবে। যার জন্য তার সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড অথবা পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
সংক্রামক রোগ আইন অনুসারে, আইনটির অধীনে সংগঠিত অপরাধের অভিযোগ, তদন্ত, বিচার ও আপিল ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে। তাই এই আইন অনুযায়ী কেউ অপরাধ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করার সুযোগ নেই। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত চাইলে দণ্ডবিধির ২৬৯-২৭১ ধারার অধীনে সংক্রামক ব্যধি ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে বিচার করতে পারে। কোয়ারেন্টাইনের আদেশ কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে এই আইনে কিছু বলা না থাকলেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পারেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সদ্য উদ্ভূত করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ রুখতে কোয়ারেন্টাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাগরিকের এমন কোন আইনি অধিকার নেই যা ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাচারী করে আপামর জনতার ক্ষতিসাধনের অনুমোদন দেয়।
তাছাড়া আইনের একটি সাধারণ নীতি হল কেউ যদি তার নিজের অথবা সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে সে অপরাধ না করলেও বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে তাকে আটক করে রাখা যায়।
অপরদিকে, কোয়ারেন্টাইন অবশ্যই কোন স্বস্তিদায়ক বিষয় না। এমনকি তা যদি নিজ বাসগৃহেও হয়। সুতরাং কাউকে কারণ না জানিয়ে, স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে বা আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া যায় না। যদিও কোয়ারেন্টাইনে নেয়া ব্যক্তি চাইলেই কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। তবে তাকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ ছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চয় জানতে চাইতে পারেন এবং কোয়ারেনটাইনকালীন সময় তিনি পর্যাপ্ত খাবার, বসবাসোপযোগী পরিবেশ, চিকিৎসা, কোয়ারেন্টাইনে যাবার কারণ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ইত্যাদি পাওয়ার অধিকারী।
কোভিড-১৯ আমাদের এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে যেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সকলকেই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে তা অবশ্যই আইনি অধিকার পরিত্যাগ করে অথবা যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী