আজ বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র চলে গেলেন। চিরবিদায় নিলেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মাধ্যমে অবসান ঘটল বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন দেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান চরিত্র। সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতির কঠিন অঙ্গনে পা রেখে দশ বছরের মাথায় দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন।
‘পুতুল’ থেকে খালেদা জিয়া:
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা খানম। বাবা ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পরিবারের সদস্যদের কাছে অত্যন্ত আদরের এই মেয়েটির ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’। তাদের পৈতৃক নিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায় হলেও স্থায়ীভাবে বসবাস ছিল দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া এলাকায়।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন তুখোড় ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর নামের সঙ্গে মিল রেখে তিনি নিজের নাম রাখেন ‘খালেদা জিয়া’। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও খালেদা জিয়া ছিলেন পুরোপুরি পর্দার অন্তরালে থাকা এক গৃহবধূ। দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়েই ছিল তার পৃথিবী। রাজনীতি নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না বললেই চলে।
রাজনীতির ময়দানে আবির্ভাব:
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি যখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতৃত্বের সংকটে ধুঁকছিল, তখন দলের অস্তিত্ব রক্ষায় নেতা-কর্মীদের অনুরোধে রাজপথে নামতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
রাজনীতিতে নামার সময় খালেদা জিয়া ছিলেন ৩৬ বছর বয়সী এক স্বামীহারা মা। যে দলটির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার বলয়ের ভেতর থেকে, সেই দলটিকে রাজপথের শক্তিতে রূপান্তর করার কঠিন চ্যালেঞ্জ তিনি একাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি যেভাবে বিপর্যস্ত বিএনপিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, তা বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল।
৯ বছরের আপোষহীন সংগ্রাম:
১৯৮২ থেকে ১৯৯০, এই নয় বছর ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অগ্নিপরীক্ষা। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন সাতদলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৬ সালে যখন অন্যান্য রাজনৈতিক দল এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, খালেদা জিয়া তখন নির্বাচন বর্জন করে রাজপথের আন্দোলনে অটল থাকেন। এই অবিচল অবস্থানের কারণেই তিনি দেশবাসীর কাছে ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই দীর্ঘ আন্দোলনে তাকে তিনবার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, তবুও তিনি আপোষ করেননি। অবশেষে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে এবং গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী:
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বিপুল বিজয় অর্জন করে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সেই নির্বাচনে তিনি পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হয়ে এক অনন্য রেকর্ড গড়েন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন। তার নির্দেশনায় পঞ্চম সংসদে এই বিল উত্থাপন ও পাস করা হয়, যার মাধ্যমে দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্ষমতার পালাবদল ও পরবর্তী শাসনকাল:
খালেদা জিয়া তিন মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ গঠনের মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের বিশাল জয়ের পর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন। তার শাসনকালে নারী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার এবং অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মতো যুগান্তকারী কাজ হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি এবং কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সমালোচনার মুখেও পড়েছেন, যার দায়ভার নিয়ে আজও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক রয়েছে।
কারাভোগ ও শারীরিক অবনতি:
রাজনীতির নিষ্ঠুর মারপ্যাঁচে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যেতে হয়। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় জেল খাটার পর এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময়ে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পান তিনি। তবে ততদিনে তার শরীর ভেঙে পড়েছিল। তিনি লিভার সিরোসিস, আর্থরাইটিস, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস ও হার্টের নানা জটিলতায় আক্রান্ত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বারবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া হলেও তৎকালীন সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০২৪ সালের জুনে তার হৃদপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয় এবং বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়।
শেষ বিদায়ের প্রহর:
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করেন। চিকিৎসার জন্য লন্ডনেও গিয়েছিলেন, কিন্তু বয়স ও দীর্ঘদিনের অযত্নে তার শরীর আর সাড়া দিচ্ছিল না। সবশেষ ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তিনি অসুস্থ বোধ করেন এবং পরদিন তাকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকেই তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও পার্থিব জীবনের ইতি টেনে চিরবিদায় নিলেন।
নক্ষত্রের পতন হয়, কিন্তু তার জ্যোতি থেকে যায় অনন্তকাল। বেগম খালেদা জিয়া আজ সশরীরে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার আদর্শ, তার দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের জন্য তার ত্যাগ প্রতিটি বাংলাদেশির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। বাংলার প্রতিটি ধূলিকণা ও ঘাসফুলে মিশে থাকবে তার নাম।
‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’।
আল্লাহ তায়ালা উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়