Tuesday 30 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খালেদা জিয়া: নারী ক্ষমতায়ন ও গণতান্ত্রিক আপসহীনতার প্রতিক

মো. শাহিন রেজা
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৪২ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৫৫

আমি যখন লেখাটি লিখছি সারা দেশর মানুষ তখন শোকে স্তব্ধ। কারণ, আজ (৩০ ডিসেম্বর) সকালে বর্তমান বাংলাদেশের সব থেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ও অভিভাবক বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। আপসহীনতা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও দেশ পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দৃঢ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারিত হবে এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে। তিনি শুধু একজন সাবেক ফাস্ট লেডি বা প্রধানমন্ত্রীই নন; তিনি নারী নেতৃত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আধিপত্যবাদ বিরোধী, দেশের স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও স্বার্বভৌমত্বের শক্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ৮০ বছর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় একটি দলের প্রধান হয়ে দেশ ও জাতি গঠন এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাতে তিনি যে সংগ্রাম করেছেন তা অকল্পনীয় এবং এসব নানাবিধ কর্মকান্ডের কারণে মানুষ তাকে আজীবন স্বরণে রাখবে।

বিজ্ঞাপন

মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় সম্ভবত ২০০৪ সালে আমার নিজ উপজেলা মহেশপুরে তাকে প্রথম দেখি। বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের উদ্ভোধন শেষে জনসভায় ভাষন দেওয়া দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে। তার সরকারের আমলে আমাদের মহেশপুর কোটচাঁদপুর আসনে যে কোনো সময়ের থেকে বেশি বিদ্যুতায়ন, রাস্তা ঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ, চাকরি, স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কাজ হয়েছিল। ফলে আজকের অন্তিম যাত্রার দিনে উপজেলায় তাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া অবস্থায় একবার দেখেছিলাম। বলতেই হবে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসা একজন নারীর পক্ষে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েও যে দৃঢ়তা, আত্মমর্যাদা ও নেতৃত্বের ভার বহন করা যায় তিনি তার জীবনের প্রতিটি ধাপে সেটিই প্রমাণ করেছেন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা ঐতিহাসিক। তার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন যা ছিল তার নেতৃত্বের অন্যতম বড় অর্জন। এবং এর মধ্যেেই তিনি আপসহীন হয়ে উঠেছিলেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, রাজপথের আন্দোলন, নির্বাচন বর্জন— সবকিছুতে তিনি দৃঢ় ছিলেন। যার মূলে ছিল জনগণের অধিকার রক্ষা ও দেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। তার আন্দোলন-সংগ্রাম, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। বেগম খালেদা জিয়া তিন বার রাষ্ট্র পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিতি কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। দায়িত্ব পালনের সময় ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তার সরকারের সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতা বা ব্যর্থতা জনগণ নির্ধারণ করবে কিন্তু তার রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার, মাটি, মানুষ ও দেশের প্রতি দরদ নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা না। তারপরও তাকে নিয়ে নানা প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে। বিশেষ করে দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ও হাওয়া ভবন নিয়ে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেইনি বরং কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে আমরাকেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে না, প্রতিটি সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য কিন্তু জিয়া পরিবারের সাথে একটু বেশিই জুলুম করা হয়েছে। তারপরও তিনি মনে রাগ পুষে রাখেননি। জীবনের শেষ সময়েও ক্ষমতার দম্ভ বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। বরং তিনি বারবার দেখিয়েছেন— ক্ষমতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই রাষ্ট্রের মূল শক্তি। ২০০৭ সালে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছু বিষয় আপোষের মাধ্যমে ক্ষমতার লোভ দেখালেও তিনি রাজি হননি এমনকি রাজনৈতিক কূটচাল, প্রতিকূলতা, বিরোধী চাপ কিংবা ব্যক্তিগত বা দলীয় সংকট— কোনো কিছুই তাকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস করতে বাধ্য করতে পারেনি। এই আপসহীনতাই তাকে সমসাময়িক রাজনীতিতে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

দেশের প্রতিটি সেক্টরের উন্নয়নে খালেদা জিয়ার ছোঁয়া রয়েছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর তিনি নারীদের জন্য বাস্তবভিত্তিক নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে বিনা বেতনে অধ্যায়ন, উপবৃত্তি কর্মসূচি বিস্তৃতকরণ গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের স্কুলে উপস্থিতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এই উদ্যোগ নারীকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করেছে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। নারীরা আজ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষা ছিল তার উন্নয়নভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ বেগম খালেদা জিয়া বিশ্বাস করতেন শিক্ষিত জাতি ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না। আমি নিজে প্রাথমিকে পড়া অবস্থায় তার সরকারের আমলে আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। উল্লেখ্য, বাবার মৃত্যুজনিত কারনে নানা বাড়ি থেকে আমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে এবং তারা বেগম খালেদা জিয়ার দলের ভোটার ছিলেন না! তিনি দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে মেধাবী ও দুস্থদের পাশে দাড়িয়েছেন সবসময়।

রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার আপসহীনতা। ফলে নানা ষড়যন্ত্র, শারীরিক অসুস্থতা কিংবা রাজনৈতিক নিপীড়ন— কোনো কিছুই তাকে নীতিগত অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি বারবার গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি শুধু নিজ দলের বা কর্মীদের কথাই বলেননি অন্য দলের অধিকার রক্ষার জন্যও কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে ধানমণ্ডির বাসা থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হলে পরেই দিনই তার মুক্তি চেয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন। দেশের অর্থনীতি মোটা দাগে দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্সের উপর যা শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের দেখানো পথে হেঁটেছেন সবসময়। এই পথে হাঁটতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে, বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেককিছু। তারপরও তিনি নীতিতে অবিচল থেকেছেন আজীবন। এই দৃঢ় অবস্থানই তাকে শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং প্রতিরোধ ও সাহসের প্রতীকে পরিণত করেছে।

সামনে জাতীয় সংবাদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে আজ যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নারী নেতৃত্ব, উন্নয়ন ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে, তখন বেগম খালেদা জিয়ার অবদান নতুন করে মূল্যায়নের দাবি রাখে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বা সরকার পরিচালাতে খালেদা জিয়ার সরকার সমালোচনা বা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বেে না কিন্তু দেশের গণমাধ্যম অনেক সময় সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি ফলে দেশ বিদেশি সঠিক তথ্য পৌঁছায়নি যা মানুষের মধ্যে ভুল কিছু ছড়িয়েছে। তারপরও হয়তো একদিন সময়ের পরিক্রমাতে আমরা নিরপেক্ষভাবে আলোচনা সমালোচনার উত্তর পাবো। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কিনবা তার বিরোধী পক্ষ বা নিন্দুকেরাও বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়ন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তার অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। আজ গণমাধ্যমে জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সুধিজনেরা খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক অবদানের কথা তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশ একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল খালেদা জিয়াকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেদের অভিভাবক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এই সংকট মূহুর্তে খালেদা জিয়াকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, এতোটা ভালোবাসা, দোয়া ও সম্মান নিয়ে কতজন পরকালের পথে রওনা হতে পারে?

লেখক: অফিসার, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ

সারাবাংলা/এনএল/এএসজি
বিজ্ঞাপন

বাণিজ্যমেলার তারিখ পরিবর্তন
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:০৭

আরো

সম্পর্কিত খবর