Sunday 28 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাড়কাঁপানো শীত; রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা ও ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার

রাকিবুল ইসলাম
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৭

পৌষের শুরু থেকেই শীত যেন এ বছর হঠাৎ করেই নিজের স্বভাব বদলে ফেলেছে। আগের মতো সহনীয়, হালকা শীত নয় এবারের শীত দীর্ঘ, ধারালো এবং হাড়কাঁপানো। রাত নামলেই তাপমাত্রা হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে,সন্ধ্যার পর থেকে ঘন কুয়াশা চারপাশ ঢেকে ফেলে এমনভাবে, যেন পরিচিত পৃথিবীটাকেই অচেনা করে দেয়। কয়েক হাত দূরের মানুষটিকে আলাদা করে চিনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সূর্য ওঠে দেরিতে, আর উঠলেও তার আলো যেন শক্তিহীন, ক্লান্ত, বিবর্ণ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু এই পরিভাষা মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে মেলে না। কারণ এই শীত মানুষের শরীর, জীবন, আয় এবং মর্যাদার ওপর যে প্রবল প্রভাব তৈরি করছে, তা কোনোভাবেই মৃদু নয়।

বিজ্ঞাপন

এই শীত কেবল একটি ঋতু নয়, কেবল আবহাওয়ার একটি অধ্যায়ও নয়। এটি রাষ্ট্রের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, উন্নয়নের দাবির সত্যতা এবং সামাজিক বৈষম্যের বাস্তব রূপ সবকিছুকে একসঙ্গে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। শীত প্রতিবছর আসে, কষ্টও প্রতিবছর হয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির জায়গায় দৃশ্যত কোনো গুণগত পরিবর্তন চোখে পড়ে না। যেন আমরা সবাই রাষ্ট্র, সমাজ, নীতিনির্ধারক শীতকে একটি অনিবার্য দুর্ভোগ হিসেবেই মেনে নিয়েছি, যার বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু করার নেই। এই আত্মসমর্পণই সবচেয়ে ভয়াবহ।

শীত কোনো গণতান্ত্রিক ঋতু নয়। এটি সবার জন্য এক রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে না। শহরের উচ্চবিত্ত মানুষের জীবনে শীত মানে গরম কাপের ধোঁয়া ওঠা চা, মোটা কম্বল, সোয়েটার,এসরুমের বিশ্রাম। অথচ একই শহরে, একই শীতে, ফুটপাতের মানুষটির রাত কাটে খোলা আকাশের নিচে, শরীর মোড়া থাকে পলিথিন আর পুরোনো কাপড়ে, চোখে ঘুম আসে না।

মফস্বলে ও গ্রামে শীত মানে কাজ কমে যাওয়া, কৃষক ক্ষেতে যেতে না পারা। শ্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়া। দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, হকার, নির্মাণশ্রমিক এই মানুষগুলোর জীবনে শীত কোনো রোমান্টিক ঋতু নয়। কুয়াশা আর তীব্র শীতে কাজ বন্ধ হয়, আয় থেমে যায়, কিন্তু ক্ষুধা থামে না। শরীর কাঁপে, কিন্তু পেটের দাবির কাছে শরীরের আরাম কোনো গুরুত্ব পায় না।

এখানেই শীত প্রকৃতির সমস্যা থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় রূপ নেয়। এটি দারিদ্র্যের কাঠামোগত রূপকে আরও নগ্ন করে তোলে। রাষ্ট্র যখন উন্নয়নের গল্প বলে, বড় প্রকল্পের হিসাব দেয়, তখন এই মানুষগুলো প্রায়ই সেই গল্পের বাইরে থেকে যায়। শীত এসে সেই বাদ পড়ার হিসাবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। উন্নয়ন যদি সত্যিই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতো, তবে প্রতিবছর শীত এলেই একই মানুষগুলো একইভাবে বিপন্ন হতো না।

ঘন কুয়াশায় যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ার দৃশ্যও নতুন নয়। সড়কে যানবাহন হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করে, ট্রেন দেরিতে চলে, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে, নৌ ও বিমান চলাচল ব্যাহত হয়। প্রতিবছর এই একই খবর আমরা পড়ি, দেখি, শুনি। অথচ প্রশ্ন হলো এটা কি সত্যিই অনিবার্য? আবহাওয়া অধিদপ্তর আগাম পূর্বাভাস দেয়, শৈত্যপ্রবাহের সময়কাল মোটামুটি জানা থাকে। তবু কেন যোগাযোগব্যবস্থায় নিরাপত্তা পরিকল্পনা, সময়সূচির বিকল্প ব্যবস্থা, যাত্রীদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা এসব প্রস্তুতি প্রতিবছরই দুর্বল থাকে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে রাষ্ট্রের চরিত্রের দিকে তাকাতে হয়। আমাদের রাষ্ট্র এখনো মূলত প্রতিক্রিয়াশীল। দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত হয়, মানুষ খুন হবার পর আসমী পালিয়ে গেলে গ্রেফতারের ঘোষণা আসে, কিন্তু আগাম প্রস্তুতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র ঝুঁকি আগে বিবেচনায় নেয়। আমাদের রাষ্ট্র কি সেই দায়িত্বশীলতার জায়গায় আসতে পারেনা!

শহরের ফুটপাত, বস্তি, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, বাজার-ঘাট এই জায়গাগুলোতে শীতের বাস্তবতা সবচেয়ে নিষ্ঠুর।ছিন্নমূল মানুষগুলো রাত কাটে কাঁপতে কাঁপতে।পথশিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাদের শরীর ছোট, প্রতিরোধক্ষমতা কম। শীতের রাতে তারা ঘুমোতে ভয় পায়। এই শিশুরা রাষ্ট্রের নাগরিক, কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। শীত এলেই কিছু ত্রাণ বিতরণের ছবি দেখা যায়, কিছু বক্তব্য শোনা যায়, তারপর তারা আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। রাষ্ট্র কি নাগরিকদের কেবল পরিসংখ্যান আর ভোটের সময় মনে রাখবে?

উত্তরাঞ্চলের শীতের গল্প আরও করুণ।পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী,গাইবান্ধা এই নামগুলো শীত এলেই সংবাদ শিরোনামে আসে। চরাঞ্চলের মানুষগুলোর ঘর বাতাস আটকাতে পারে না। হাড়কাঁপানো শীতে মানুষ টিকতে পারেনা। কম্বল নেই, গরম কাপড় নেই,ঘরে খাবার নেই।এই দুর্ভোগ নতুন নয়, কিন্তু সমাধানও আসে না। মনে হয় উত্তরাঞ্চলের শীত রাষ্ট্রের কাছে একটি মৌসুমি সংবাদ, কোনো স্থায়ী নীতিগত সমস্যা নয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এই অঞ্চলের শীতঝুঁকির আলাদা গুরুত্ব দেখা যায় না। উন্নয়নের জাতীয় সূচকে এই মানুষগুলোর অবস্থান কোথায় সে প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায়।

শীতের সঙ্গে পুষ্টিহীনতার সম্পর্ক আরও গভীর। অপুষ্ট শিশুদের শরীর ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, জ্বর শীতে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে শীত মানে জ্বর,সর্দি,শ্বাসকষ্টসহ শীরের নানান সমস্যা।অনেক বৃদ্ধ একা থাকেন, শীতে তাদের খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। এই স্বাস্থ্যঝুঁকি কেবল চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়; এটি দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ফল। রাষ্ট্র যখন খাদ্য,পুষ্টি,বাসস্থান ও সামাজিক সুরক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন বিভিন্ন রকম সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে।

প্রতিবছর শীত বাড়লে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ে। এটি নতুন নয় তবু গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ওষুধ, জনবল ও সরঞ্জামের ঘাটতি থেকেই যায়। শৈত্যপ্রবাহের সময় ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার ও এলাকা চিহ্নিত করা, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা এখনো নীতিগতভাবে বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠেনি। ফলে প্রতিবছর শীত আসে, প্রতিবছর রোগ বাড়ে, আর আমরা প্রতিবছরই নতুন করে বিস্মিত হই। এই বিস্ময় আসলে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ঢাকার একটি উপায়।

শীত এলেই কম্বল বিতরণের রাজনীতি শুরু হয়। সহায়তা প্রয়োজনীয়,এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সহায়তা কি সময়মতো, সঠিক মানুষের কাছে, সম্মানের সঙ্গে পৌঁছায়? নাকি এটি মৌসুমি প্রদর্শনীতে পরিণত হয়? অনেক সময় কম্বল আসে দেরিতে, প্রকৃত দরিদ্র মানুষ বাদ পড়ে। কোথাও কোথাও শীত প্রায় শেষ হওয়ার পর বিতরণের ছবি দেখা যায়। ত্রাণ যদি নীতিনির্ভর না হয়, তবে তা সহায়তা নয়—তা রাজনৈতিক প্রচারণা হয়ে ওঠে।

শীতকালে কাজ না পেলে দরিদ্র মানুষের সবচেয়ে বড় সংকট হয় খাদ্য। একদিন কাজ না মানে একদিন না খাওয়া। তাই শীত মোকাবিলায় শুধু কম্বল নয়, খাদ্য সহায়তা ও অস্থায়ী কর্মসংস্থানের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। শীতকালীন কর্মসূচি, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, নগরভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি কাজ—এসব উদ্যোগ শীতের কষ্ট কমাতে পারে। এটি দয়া নয়; এটি নাগরিক মর্যাদার প্রশ্ন। রাজনীতির ভাষায় শীত খুব কমই জায়গা পায়। শীত ভোটের ইস্যু নয়, তাৎক্ষণিক লাভের বিষয়ও নয়। ফলে নীতিনির্ধারণে শীতার্ত মানুষের কষ্ট প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের মান নির্ধারিত হয় সে তার সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করে এই প্রশ্নে।শীত সেই পরীক্ষার সময়। উন্নয়নের দাবি তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়, যখন দুর্ভোগের সময় রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয়।নাগরিক সমাজ ও ব্যক্তির দায়ও অস্বীকার করা যায় না। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো কোনো দয়া নয়; এটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। তবে নাগরিক উদ্যোগ রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিকল্প হতে পারে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

শীত কিছুদিন পর চলে যাবে। সূর্য আবার উজ্জ্বল হয়ে দিনের আলোতে তাপ ছড়িয়ে দেবে।কিন্তু এই শীতে যদি রাষ্ট্র, সমাজ এবং আমরা কেউই দায়িত্ব না নিই, তাহলে উন্নয়ন আর মানবিকতার গল্পের আড়ালে একটি গভীর শূন্যতা থেকেই যাবে। রাষ্ট্রকে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নিতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, দুর্বল নাগরিকদের জীবনকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। কারণ শীত শেষ হলেও, মানুষের দুর্ভোগ শেষ হয় না। এবং সেই দুর্ভোগের দায়িত্বও কখনো শেষ হয় না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে হবে প্রতিটি নাগরিককে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার সুযোগ নিশ্চিত করা।

লেখক: কলামিস্ট