রাতের খাবারের টেবিলটা হঠাৎ করেই এক ভারী নিস্তব্ধতায় ডুবে গেল। আব্বু এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। আজ হাসপাতালে মাত্র দুই বছরের এক শিশুকে আনা হয়েছিল। শিশুটির অপরাধ ছিল সে টলমল পায়ে সবার অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরটিতে পড়ে গিয়েছিল। চিকিৎসক যখন তাকে মৃত ঘোষণা করলেন, তখন তার বাবা-মায়ের যে বুকফাটা আর্তনাদ, তার বর্ণনা দেওয়ার ভাষা নেই।
খাওয়া শেষ করে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতেই বুকটা ধক করে উঠল। টাইমলাইনে দেখি পরিচিত একজন শেয়ার করেছেন, তাদের পরিবারের এক শিশুও আজ পুকুরে ডুবে মারা গেছে। একই দিনে দুটি মৃত্যুর সংবাদ। আমাদের কাছে এগুলো হয়তো কেবল স্ক্রল করে যাওয়া কিছু ‘নিউজ আপডেট’, কিন্তু দুটি পরিবারের কাছে আজ পৃথিবীটা থমকে গেছে। একটি ঘরের প্রদীপ চিরতরে নিভে গেছে। অথচ আমরা কি একবারও ভেবে দেখছি, কেন এমনটা বারবার ঘটছে? কেন আমাদের দেশের শিশুরা পানির কাছে এত অসহায়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ-এর বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। সরকারি-বেসরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। এর অর্থ হলো, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জন শিশু না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। ভাবতে পারেন? একটি পুরো ক্লাসরুমের সমান সংখ্যক শিশু প্রতিদিন স্রেফ সচেতনতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে!
বিশ্বের অনেক দেশ সংক্রামক ব্যাধি বা অপুষ্টি রোধে সফল হয়েছে, বাংলাদেশও এক্ষেত্রে উদাহরণ। কিন্তু এই যে ‘নীরব মহামারি’ বা পানিতে ডুবে মৃত্যু একে আমরা এখনো সেভাবে জাতীয় গুরুত্ব দিচ্ছি না।
আমরা সচরাচর ভাবি, শিশু হয়তো উত্তাল নদী বা বড় কোনো বিলে ডুবে মারা যায়। কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। একটি শিশুর ডুবে যাওয়ার জন্য বিশাল জলাশয়ের দরকার হয় না; মাত্র কয়েক ইঞ্চি গভীর পানিই তার ফুসফুস অকেজো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে বাড়ির মাত্র ২০ থেকে ৩০ গজের মধ্যে থাকা ছোট পুকুর বা ডোবায়।
দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। সাধারণত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে। যখন বাড়ির পুরুষরা কাজে থাকেন এবং মায়েরা ঘরের রান্নাবান্না বা গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। ঠিক সেই সময়টাতেই কৌতূহলী শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে বা টলমল পায়ে বাইরে চলে যায়। মা ভাবছেন শিশুটি হয়তো বারান্দায় খেলছে, কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এই নজরদারিহীন সময়টুকুই জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
শহরের আধুনিক ফ্ল্যাটে আমরা যখন ভাবি শিশু নিরাপদ, সেখানেও লুকিয়ে আছে বিপদ। বাথরুমের এক বালতি জমানো পানি বা বাথটাব একজন শিশুর জন্য মরণফাঁদ হতে পারে। শিশু যখন কৌতূহলবশত বালতির পানিতে উঁকি দেয় বা মুখ ডোবায়, তখন তার শরীরের ভারকেন্দ্রের কারণে সে নিজেকে আর টেনে তুলতে পারে না। আমাদের কাছে যা সামান্য বালতি ভর্তি পানি, একটি অবুঝ শিশুর কাছে তা মৃত্যুর নীল কুয়াশা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এই প্রতিটি ঘটনা শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন কেবল ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ।
নিরাপত্তার স্বার্থে বাড়ির আশেপাশে থাকা পুকুর বা গর্তের চারপাশ অন্তত ৩-৪ ফুট উঁচু বাঁশ কিংবা জালের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা জরুরি। ঘরের ভেতরে বাথরুমের দরজা সর্বদা বন্ধ রাখা এবং বালতি বা গামলা ব্যবহারের পর খালি করে উল্টে রাখার অভ্যাস করতে হবে।
গবেষণা বলছে, ৪ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সাঁতার শেখাতে পারলে পানিতে ডোবার ঝুঁকি প্রায় ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব। তাই প্রতিটি স্কুল বা এলাকায় সাঁতার শেখানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়া, পানি থেকে তোলার পর প্রথম কয়েক মিনিট বা ‘গোল্ডেন টাইম’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়ার সঠিক নিয়ম যদি পরিবারের অন্তত একজনের জানা থাকে, তবে অনেক মৃতপ্রায় শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
আজকের সেই শিশুটির বাবার আর্তনাদ আর আপনার আমার টাইমলাইনের শোকবার্তা যেন একই সুতোয় গাঁথা। আসুন, সচেতনতা শুরু করি নিজের ঘর থেকেই। বাথরুমের বালতিটা খালি রাখি, পুকুরের পাড়ে একটা বেড়া দিই। আমাদের সামান্য একটু সাবধানতা যদি একটি শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারে, তবে সেটাই হবে এই সমাজের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। আমরা চাই না আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি হোক। শিশুদের রঙিন শৈশব টলটলে পানির নিচে অকালে হারিয়ে যাক এটা কারোরই কাম্য নয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী