Thursday 25 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রত্যাশা প্রাপ্তির দোলাচলে অর্থনীতি

ড. মিহির কুমার রায়
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:০১

৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল গগনচুম্বী। তারা আশা করেছিল নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করবে, অর্থনীতিকে গতিশীল করবে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া ছিল একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়া এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। একবছর পর যদিও কয়েকটা অর্থনৈতিক সূচক কিছুটা উন্নতি করেছে, তবে অধিকাংশ সূচকই এখনো আগের দুর্বল অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় এখন আগের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হলো:

বিজ্ঞাপন

আথির্ক খাত

ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্দশা কাটেনি। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এখাতে সুশাসন ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যাংক খাত আরও ভালো করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, আর আইএমএফের বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে তা ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল থাকায় ডলারের ওপর চাপ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করায় পরিস্থিতি আরও উন্নত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাজেট সহায়তা ও ঋণ হিসেবে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তাও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রিত থাকায় ডলারের চাহিদা কমে বিনিময় হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি, এতদিন নীতিমালায় যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করো আগের সরকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে। যার অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে ৫টি ইসলামী ধারার ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংককে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশি ভালো বিনিয়োগকারী এনে শক্তিশালী করার চিন্তা চলছে। মোট ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা একটি সুদৃঢ়,স্বচ্ছ ও সংগঠিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার অংশ। সরকারের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ছয়টি নতুন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যার মধ্যে ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট সংশোধনের কাজও চলছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি

প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ। তার আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। যার তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রেমিট্যান্সের সেই জোয়ার ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও চলমান। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। আগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় এটি প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।

অর্থপাচার রোধ

নতুন সরকার অর্থপাচার রোধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ায় সুফল পেয়েছে দেশের অর্থনীতি। এদিকে অর্থপাচার রোধে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এখন কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অর্থ আত্মসাতে জড়িত গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা। আরেকটি হতাশার জায়গা হলো- বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি করা অর্থ পুনরুদ্ধার। বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্য সংক্রান্ত চালানে ফাঁকিজুঁকি দেয়া হয়েছে, অবৈধ স্থানান্তর এবং ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও প্রকৃত পুনরুদ্ধার ছিল নগণ্য। বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব ও শক্তিশালী দেশীয় তদন্ত ক্ষমতা ছাড়া এ সমস্যা টিকে থাকবে।

মূলধন বাজার

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩০ জুন সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ৩২ লাখ ৪ হাজার ৬০৩টি। বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪৮টিতে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫ জন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের অনেকেই মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। পরে তাদের অনেককেই মাথায় হাত দিয়ে বাজার ছাড়তে হয়েছে। কেউ কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখনই সময়-পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়ার। সম্ভাবনা আছে, সামর্থ্য আছে। দরকার কেবল সদিচ্ছা। আস্থাহীনতার কারণে বিগত ৮ বছরে কমপক্ষে ১৬ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী কোনোভাবে টিকে আছেন। দীর্ঘদিন ধরে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি,ভালো শেয়ারের মূল্য বাড়তে না দেওয়া,বাজার নিয়ন্ত্রণে কমিশনের নিষ্ক্রিয়তাসহ বেশ কিছু কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনার মধ্যে আছে – সরকারি মালিকানাধীন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত এবং দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহিত করতে প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বাজার সংস্কার, পুঁজিবাজারের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমাতে বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হলে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে।

বিনিয়োগে স্থবিরতা

নগদ টাকার (তারল্য) সংকট ও নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুন থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পায়নি। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার আরো লাগামহীন। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কাজেই আসেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। একই সময়ে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বিরল। অথচ এই বিপুল অর্থ দেশের উৎপাদন খাতে প্রবেশ না করে অলস অবস্থায় পড়ে আছে,যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে। অপরদিকে,ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও একই সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ যারা ব্যাংকে টাকা রাখছেন না তারাও অর্থ ব্যয় না করে জমিয়ে রাখছেন। ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারে চাহিদা সৃষ্টির গতি মন্থর হবে, বিনিয়োগ আসবে না, উৎপাদন বাড়বে না এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে না। বিনিয়োগে স্থবিরতা বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছেন। করোনা মহামারীর ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা- এই তিনটি বড় ধাক্কা বিনিয়োগকারীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা। বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত নীতি নির্ধারণ, আইনশৃঙ্খলা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ছাড়া বড় বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।

মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হারে বিধিনিষেধ শিথিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং সরকারি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দৈনন্দিন পণ্যের ক্ষেত্রে এলসি-বিষয়ক বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়ে এবং খাদ্য ও সার আমদানিকারকদের জন্য ঋণের সুবিধা দিয়ে সরবরাহজনিত সমস্যা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে যাতে মূল্যস্ফীতি না বাড়ে। প্রথম দিকে তেমন ফলাফল দেখা না গেলেও মূল্যস্ফীতি এখন কমার দিকে। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অংকে থাকার পর তা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। জুলাই ২০২৪-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ,যা ২০২৫ সালের জুনে এসে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এই কম প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা,সরবরাহ ব্যবস্থা-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা, চাহিদার হ্রাস এবং সঠিক আর্থিক প্রণোদনার অভাব।

সামষ্টিক অর্থনীতি

ভেঙে পড়া সামষ্টিক অর্থনীতিকে জোড়া লাগানোর একটা জরুরি কাজ ছিল। এটি অন্তর্বর্তী সরকার সফলভাবেই করতে পেরেছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা একটা বিষয় আর সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের স্বস্তি আরেকটা বিষয়। সেখানে প্রশ্ন আছে। রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক শাসনের সূচকে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি ইত্যাদি। অর্থাৎ এখানে সরকারের সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি স্পষ্ট। ঘোষণা অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু ঘোষণা ও বাস্তবায়নের ফারাক বিস্তর।

সংস্কার উদ্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে আলোচিত দিক ছিল বিভিন্ন খাতে সংস্কার উদ্যোগ। যদিও সরাসরি অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি, পরিকল্পনা উপদেষ্টা একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সমতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল তৈরি করা। এই টাস্কফোর্স রিপোর্টে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হলেও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো স্বল্পমেয়াদে কিছু সুপারিশের বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরো একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। কিন্তু স্বৈরাচার বিলোপের গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষঙ্গ নজরে আনা হয়নি। অতি ক্ষমতায়িত প্রধান নির্বাহী ক্ষমতা নিয়েই কেবল আলোচনা হয়েছে। যেমন-প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ কতদিন হবে ইত্যাদি। স্বৈরাচারের এটিই একমাত্র স্তম্ভ নয়। আরও চার-পাঁচটি বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় সরকার যার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি, তাকে সার্বিকভাবে আরও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। সরকার একটা কমিশন করেছে। কমিশন প্রতিবেদন দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং স্থানীয় সরকারেও আমলাদের বসানোর প্রবণতা দেখা গেছে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ সরকারের আমলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে স্বস্তি এসেছে, কিন্তু অর্থনীতি এখনও ঘুরে দাঁড়ায়নি। এ জন্য টেকসই সংস্কার দরকার। ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ তখনই দেখতে পাব-যখন মূল্যস্ফীতি এমন এক পর্যায়ে নামবে যে,কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমাবে। এতে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ,পুঁজি পণ্যের আমদানি এবং জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়বে। তখন আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেখব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার একটি জরুরি কিন্তু অসমাপ্ত এজেন্ডা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দুর্বল নীতি প্রয়োগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার পেশাদারিত্ব আনার কথা বললেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ-যেমন কার্যনির্বাহী স্বাধীনতা বাড়ানো, তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোকে আধুনিকীকরণ এবং নীতিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা-এখনো নেয়া হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন

আরেকটি আলোচিত সংস্কার হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন। গত ১২ মে সরকার ‘রেভিনিউ পলিসি অ্যান্ড রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট অর্ডিন্যান্স’জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুটি আলাদা বিভাগে ভাগ করার ঘোষণা দেয়- ‘রেভিনিউ পলিসি বিভাগ’ এবং ‘রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ’। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত ছিল। সরকারের আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি হয়নি। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় গত অর্থবছরে আরও কমেছে। কর ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। রাজস্ব ব্যয় বিশেষত বেতন-ভাতা, ভর্তুকি এবং ঋণের সুদ পরিশোধ এতটাই বেড়েছে যে, আমরা রাজস্ব আয়-ব্যয় উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ে দিতে পারছি না। উন্নয়ন ব্যয়ের পুরোটা ঋণনির্ভর হয়ে গেছে। সরকারের আয় ও ব্যয়ের এই দুর্বলতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ আগামীতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠ মনোযোগ দরকার।

নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ফাংশনগুলোকে আলাদা ইউনিটে-রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভক্ত করলে ২০২৮ সালের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানের ৮-৯ শতাংশে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত।

কর্মসংস্থান

গত একবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈষম্য হ্রাসের প্রত্যাশা পূরণে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। মনে রাখতে হবে, বৈষম্যবিরোধী চেতনার মধ্য দিয়ে দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের ফসল যদি পিছিয়ে পড়া মানুষের উপকারে না আসে, কৃষক যদি ন্যায্যমূল্য না পায় এবং শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি যদি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম থেকে যায়, তাহলে খুবই পরিতাপের বিষয় হবে। এছাড়া বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক বিপন্নতা বেড়েছে। মাথায় রাখতে হবে, অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতার প্রশংসা আমরা করছি, তার মধ্যে একটি কালো প্রচ্ছায়া কিন্তু রয়ে গেছে। এখানে সরকারের মনোযোগ বাড়ানো খুবই জরুরি। অভ্যন্তরীণভাবে শ্রমবাজারে নতুন তরুণদের আগমনের তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি পিছিয়েছিল। কৃষি সংযুক্ত ভ্যালুচেইন বা ক্ষুদ্র আকারের উৎপাদন শিল্পের মতো শ্রমঘন খাতে বিনিয়োগ ছিল দুর্বল। অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা জালের সঙ্গে এটি যুক্ত হয়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। চরম দারিদর্্েযর হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংকের। বৈদেশিক বাজারের দিক থেকে প্রবাসী শ্রমবাজার পর্যাপ্ত সহায়তা পায়নি। নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, উন্নত প্রশিক্ষণ ও অভিবাসীদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষার এখনো অভাব রয়েছে।

শেষ কথা

বিগত একবছরে অন্তর্বর্তী সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অনেক কম। অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বজায় রয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রাথমিক উৎসাহ ছিল তা ধীরে ধীরে কমে গেছে। তাদের জীবনের গুণগত পরিবর্তন হয়নি। সরকার থেকে যা বলা হয়েছিল তা বাস্তব রূপ পায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে, যা মানুষকে আশাহত করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে বিভিন্ন প্রণোদনা বন্ধ হওয়া, উচ্চ সুদের হার এবং বিনিয়োগ হ্রাস আগামী অর্থবছরগুলোতেও প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ-টেকসই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন এমন একটি সার্বজনীন সংস্কার যার প্রভাব অনুভূত হবে প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে, প্রতিটি মাঠে এবং প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। যে সংস্কার মানুষের মর্যাদা, সুযোগ এবং আশার বার্তা নিয়ে আসবে। এর বাইরে কিছু হলে তা হবে শুধুই পুরনো ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি। আর এর সুফল পেতে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দেয়ার বিকল্প নেই। আর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরই নিতে হবে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, সাবেক পরিচালক (বার্ড), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন ও বানিজ্য অনুষদ), সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

বিজ্ঞাপন

সংবর্ধনা মঞ্চে তারেক রহমান
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৮

আরো

সম্পর্কিত খবর