Thursday 25 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জনপ্রশাসনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সুযোগ ও সতর্কতার পথ

সাইফুল ইসলাম শান্ত
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৪১

একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার উৎস ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। আগে যেখানে সিদ্ধান্তের কেন্দ্র ছিল কাগজের ফাইল, অভিজ্ঞতা আর অনুমানের ওপর নির্ভরশীল প্রশাসন, সেখানে এখন জায়গা করে নিচ্ছে ডেটা, অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো কর আদায় থেকে অপরাধ দমন, জনসেবা থেকে নীতিনির্ধারণ সব ক্ষেত্রেই এআইকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও কার্যকর করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক রূপান্তরের বাইরে নয়। তবে এই সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে গভীর শাসনগত চ্যালেঞ্জ, নৈতিক প্রশ্ন এবং সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তাই প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দায়িত্বশীলভাবে শাসনব্যবস্থার অংশ করতে পারবে, নাকি প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে নতুন সংকটে পড়বে?

বিজ্ঞাপন

আমরা ইতোমধ্যে দৈনন্দিন জীবনে এআইয়ের প্রভাব অনুভব করছি। স্মার্টফোনের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট ফিল্টারিং, অনলাইন কেনাকাটার রেকমেন্ডেশন সিস্টেম কিংবা ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বিশ্লেষণ এসবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তব প্রয়োগ। বাংলাদেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ই-কমার্স, রাইড শেয়ারিং, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং টেলিকম খাতে এআই ইতোমধ্যেই ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তকে দ্রুত ও কার্যকর করেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান গ্রাহক আচরণ বিশ্লেষণ, প্রতারণা শনাক্তকরণ এবং চাহিদার পূর্বাভাসে এআই ব্যবহার করছে। এর ফলে কমছে খরচ, সেই সাথে সময়ও কম লাগছে। তাই বলা যায় সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে এআই উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াতে পারে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে অপরাধ বিশ্লেষণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, মুখ শনাক্তকরণ এবং ডিজিটাল ফরেনসিকসে এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সিসিটিভি নেটওয়ার্ক, ট্রাফিক ক্যামেরা ও ডিজিটাল ডাটাবেস রয়েছে। এসবের সঙ্গে এআই যুক্ত হলে অপরাধের ধরণ বিশ্লেষণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শনাক্তকরণ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহার করলে যানজট কমানো, দুর্ঘটনার ঝুঁকি নির্ণয় এবং সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হতে পারে। তবে এখানে একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে—নাগরিকের গোপনীয়তা ও মানবাধিকার। আইন-শৃঙ্খলার নামে যদি নজরদারি বাড়ে এবং তথ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে এআই সুবিধার বদলে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জায়গা হলো জনপ্রশাসনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্তে ধীরগতি এবং তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার অভাবে ভুগছে। এআই এই জায়গায় বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ভূমি প্রশাসনে জমির রেকর্ড বিশ্লেষণ, কর ব্যবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ ফাঁকি শনাক্তকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন কিংবা স্বাস্থ্য খাতে রোগের প্রবণতা বিশ্লেষণ—সব ক্ষেত্রেই এআই ব্যবহার প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনিয়ম কমানো এবং প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা সম্ভব। একইভাবে সরকারি প্রকল্পের অগ্রগতি মূল্যায়নে এআই ব্যবহার করলে ব্যয় বৃদ্ধি ও বিলম্ব আগেভাগেই শনাক্ত করা যেতে পারে।

নীতিনির্ধারণেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। বড় আকারের ডেটা বিশ্লেষণ করে অর্থনৈতিক প্রবণতা, শ্রমবাজারের পরিবর্তন বা নগরায়নের চাপ বোঝা সহজ। উন্নত দেশগুলোতে ‘ডেটা-ড্রিভেন পলিসি’ এখন বাস্তবতা। বাংলাদেশ যদি এআইয়ের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণে তথ্যভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে, তাহলে অনেক সিদ্ধান্তই হবে বেশি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর। তবে এখানেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডেটার মান ও প্রাপ্যতা। বাংলাদেশের সরকারি ডেটাবেসগুলো এখনো বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো। দুর্বল ডেটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এআই সিদ্ধান্ত নিলে তা ভুল ফলাফল দিতে পারে। যা প্রশাসনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।

এআই সংযুক্ত জনপ্রশাসনের পথে আরেকটি বড় বাধা হলো দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার পরিচালনা, বিশ্লেষণ ও তদারকির জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল। বাংলাদেশে এখনো সরকারি পর্যায়ে ডেটা সায়েন্টিস্ট, এআই বিশেষজ্ঞ কিংবা সাইবার নীতিবিদদের সংখ্যা খুবই সীমিত। ফলে অনেক সময় প্রযুক্তি কেনা হলেও তার পূর্ণ ব্যবহার হয় না। পাশাপাশি প্রশাসনিক মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে শুধু মানবিক বিবেচনা না, যদি তথ্য ও বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া না হয় তাহলে এআই কেবল সাজসজ্জার প্রযুক্তি হয়ে থাকবে।

এআই ব্যবহারে নৈতিকতা ও শাসনব্যবস্থা সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেহেতু মানুষের তৈরি অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভরশীল তাই সেখানে পক্ষপাত, ভুল বা বৈষম্য ঢুকে পড়ার ঝুঁকি থাকে। যদি সরকারি সেবায় ব্যবহৃত এআই কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, অঞ্চল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তা সামাজিক বৈষম্য বাড়াতে পারে। তাই এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা, ব্যাখ্যাযোগ্যতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। নাগরিককে জানতে হবে—কোন সিদ্ধান্তে এআই ব্যবহার হয়েছে, তার যুক্তি কী এবং প্রয়োজনে আপিলের সুযোগ কোথায়।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, একটি সুস্পষ্ট জাতীয় এআই শাসন কাঠামো প্রয়োজন। যেখানে ডেটা সুরক্ষা, গোপনীয়তা, নৈতিকতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ স্পষ্ট থাকবে। দ্বিতীয়ত, জনপ্রশাসনে এআই ব্যবহারের আগে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষা করা উচিত যেন ভুলের ঝুঁকি কমে। তৃতীয়ত, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এআই ও ডেটা লিটারেসি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। চতুর্থত, বেসরকারি খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে গবেষণা ও উদ্ভাবন বাড়াতে হবে। সর্বশেষ, নাগরিকের আস্থা অর্জনের জন্য এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক নজরদারি নিশ্চিত করা জরুরি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি দক্ষতা বাড়ায়, দুর্নীতি কমায় এবং নাগরিক সেবাকে সহজ করে তবে তা হবে উন্নয়নের শক্তিশালী মাধ্যম। আর যদি তা ব্যবহৃত হয় অপরিকল্পিতভাবে, জবাবদিহি ছাড়া তবে তা নতুন বৈষম্য ও আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে। তাই এআই ও শাসনব্যবস্থার সংযোগে আমাদের পথচলা হতে হবে সতর্ক, মানবকেন্দ্রিক এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে। ভবিষ্যতের প্রশাসন শুধু স্মার্ট নয়, হতে হবে ন্যায্য ও বিশ্বাসযোগ্য—এই উপলব্ধিই হতে পারে এআই যুগে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

কুমিল্লায় পিস্তলসহ যুবক আটক
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২৪

আরো

সম্পর্কিত খবর