Thursday 18 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রবাসী ও অভিবাসন নীতি: রেমিট্যান্সের বাইরেও যে দায় রাষ্ট্রের

মাসুদ রানা
১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:১৪

বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোর একটি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। শিল্প, রপ্তানি ও কৃষির পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার অন্যতম ভরসা হয়ে আছে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে এই অবদান যতটা গৌরবের, এর মানবিক দিকটি ততটাই অনালোচিত। কারণ রেমিট্যান্স কোনো বিমূর্ত সংখ্যা নয়; এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের শ্রম, ত্যাগ, অনিশ্চয়তা ও অনেক ক্ষেত্রে নীরব বঞ্চনার দীর্ঘ গল্প। তাই অভিবাসন নীতিকে কেবল আয়ের প্রবাহ হিসেবে দেখলে বাস্তবতার একটি বড় অংশ অদৃশ্য থেকে যায়। এই নীতি আসলে রাষ্ট্রের মানবিক দায়বদ্ধতা, কূটনৈতিক সক্ষমতা এবং নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববোধের স্পষ্ট প্রতিফলন।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে একটি চিত্রই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সামনে আসে—তারা মূলত অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক এবং কর্মরত আছেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্মাণ, গৃহস্থালি, কৃষি ও পরিষেবা খাত অভিবাসী শ্রমিক ছাড়া কার্যত অচল। অথচ এই খাতগুলোর শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা, আইনি সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সবচেয়ে দুর্বল। অর্থাৎ যে শ্রমের ওপর গন্তব্য দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, সেই শ্রমিকরাই সেখানে সবচেয়ে অনিরাপদ।

নির্মাণ খাতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বাস্তবতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রচণ্ড গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রপাতি—সবকিছুর মধ্যেই তারা কাজ করেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ন্যূনতম নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা স্বাস্থ্যবীমা পান না। দুর্ঘটনায় আহত হলে বা প্রাণ হারালে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘ হয়। সাব-কন্ট্রাক্টিং ব্যবস্থার কারণে প্রকৃত নিয়োগকর্তাকে চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে দায় এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের জীবন যেন পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা মাত্র।

গৃহস্থালি কর্মীদের অবস্থা আরও সংবেদনশীল ও নীরব সংকটে ভরা। তারা ব্যক্তিগত বাসাবাড়িতে কাজ করায় রাষ্ট্রীয় নজরদারি প্রায় অনুপস্থিত। কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়, বিশ্রামের সুযোগ সীমিত, আর নিয়োগকর্তার আচরণের ওপরই তাদের দৈনন্দিন নিরাপত্তা নির্ভর করে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, খাবার ও চিকিৎসা বঞ্চনা, এমনকি যৌন হয়রানির অভিযোগও বিভিন্ন সময় সামনে আসে। কিন্তু বাসাবাড়ির ভেতরে ঘটে যাওয়া এসব নির্যাতন প্রমাণ করা কঠিন হওয়ায় আইনি সহায়তা পাওয়া আরও জটিল হয়ে ওঠে। ফলে অনেক ঘটনা নীরবে চাপা পড়ে যায়।

কৃষি ও পরিষেবা খাতেও শোষণের ধরন ভিন্ন হলেও মূল বাস্তবতা একই। মৌসুমি কাজের অজুহাতে কম মজুরি, অতিরিক্ত শ্রম এবং চাকরির স্থায়িত্বহীনতা এখানে প্রায় নিয়মিত ঘটনা। অনেক দেশে ভিসা ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা যে শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার সঙ্গে কার্যত বন্দি হয়ে যান। কাজের পরিবেশ খারাপ হলেও চাকরি বদলানোর সুযোগ থাকে না, ফলে বাধ্য হয়ে শোষণ মেনে নিতে হয়।

সবচেয়ে গুরুতর ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ভয়াবহ বিষয় হলো চুক্তি লঙ্ঘন ও পাসপোর্ট জব্দ। দেশে থাকা অবস্থায় যে শর্তে শ্রমিকরা চুক্তি করেন, বিদেশে গিয়ে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল অনেক সময়ই থাকে না। বেতন কমিয়ে দেওয়া, কাজের ধরন ও সময় একতরফাভাবে বদলে দেওয়া প্রায় নিয়মিত ঘটনা। পাসপোর্ট জব্দের মাধ্যমে তাদের চলাচল ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিক শ্রম ও মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

এই ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতার পেছনে কাঠামোগত কিছু কারণ রয়েছে। ভাষাগত অজ্ঞতা, স্থানীয় আইন সম্পর্কে সীমিত ধারণা, দালালনির্ভর নিয়োগ ব্যবস্থা এবং প্রেরক ও গন্তব্য—উভয় দেশের তদারকির দুর্বলতা শ্রমিকদের শোষণকে সহজ করে তোলে। ফলে তারা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সামাজিক ও মানসিকভাবেও এক ধরনের স্থায়ী অনিরাপত্তার মধ্যে জীবনযাপন করেন।

এই অবস্থায় আইনি সহায়তা পাওয়াও সহজ নয়। ভাষার বাধা, আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং সহায়তামূলক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা শ্রমিকদের আরও দুর্বল করে তোলে। তবে এই সংকটের দায় শুধু গন্তব্য দেশের আইন বা নিয়োগকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে বাস্তব চিত্রটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রেরক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রস্তুতি, তদারকি ও কূটনৈতিক তৎপরতার ঘাটতিও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে।

বিদেশে যাওয়ার আগে অনেক শ্রমিকই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, চুক্তির শর্ত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা বা নিজের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা পান না। দালালনির্ভর অভিবাসন ব্যবস্থা, অতিরিক্ত ব্যয় ও প্রতারণা তাদের শুরু থেকেই এক ধরনের অসহায় অবস্থানে ঠেলে দেয়। ফলে বিদেশে গিয়ে তারা সহজেই শোষণের শিকার হন, অথচ দেশে ফিরে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও কঠিন হয়ে পড়ে।

কূটনৈতিক পর্যায়েও এই সমস্যার প্রতিফলন স্পষ্ট। অনেক দেশে বাংলাদেশি দূতাবাস বা শ্রম উইং থাকলেও সেগুলোর জনবল, সক্ষমতা ও কার্যকারিতা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। সংকটে পড়া শ্রমিকরা সময়মতো সহায়তা পান না, অভিযোগ নিষ্পত্তি দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে থাকে, আর আইনি লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থন অনেক সময়ই দুর্বল হয়ে পড়ে। অথচ মানবসম্পদ রপ্তানি যখন অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি, তখন সেই মানবসম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।

এখানেই মানবসম্পদ কূটনীতির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা আজ আর কেবল সামাজিক সহানুভূতির বিষয় নয়; এটি কার্যকর কূটনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে শ্রম চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডিতে আটকে না রেখে বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা, স্বাস্থ্যসেবা, আইনি সহায়তা এবং দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে না আনলে প্রবাসী কল্যাণের অঙ্গীকার অর্থহীন হয়ে পড়বে।

একই সঙ্গে অভিবাসনের আগে প্রস্তুতির মান বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি ও শ্রম আইন সম্পর্কে ধারণা থাকলে শ্রমিক শুধু বেশি আয়ই করেন না, বরং নিজের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন থাকেন। দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি মানে কেবল রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নয়; এটি ঝুঁকি কমানো এবং প্রবাসী জীবনের মান উন্নয়নের একটি টেকসই পথ।

দেশের ভেতরের অভিবাসন ব্যবস্থাপনাও গভীর সংস্কারের দাবি রাখে। দালালচক্র, অতিরিক্ত ব্যয় ও প্রতারণা বহু পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশযাত্রার খরচ মেটাতে গিয়ে একটি পরিবার বছরের পর বছর ঋণের বোঝা বহন করে। অথচ স্বচ্ছ ডিজিটাল নিবন্ধন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার কঠোর তদারকি এবং আইন প্রয়োগ জোরদার করা হলে এই অনিয়ম অনেকটাই কমানো সম্ভব।

আরেকটি প্রায় উপেক্ষিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসীদের পুনর্বাসন। কর্মজীবন শেষে বা সংকটের কারণে দেশে ফেরা বহু প্রবাসী কোনো সুসংগঠিত সহায়তা পান না। তাদের সঞ্চিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর মতো নীতি না থাকায় তারা বেকারত্ব ও সামাজিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। অথচ সঠিক পুনর্বাসন, উদ্যোক্তা সহায়তা ও দক্ষতা রূপান্তরের সুযোগ দিলে তারা দেশের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি হয়ে উঠতে পারেন।

সব মিলিয়ে একটি আধুনিক অভিবাসন নীতি কেবল রেমিট্যান্স বাড়ানোর কৌশল নয়; এটি রাষ্ট্রের মানবিক চরিত্রের পরিচায়ক। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির নীরব নায়ক। তারা যেন নীতির অন্ধকারে হারিয়ে না যান—এই দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। মানবসম্পদ কূটনীতি, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সুরক্ষা—এই চারটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশের অভিবাসন নীতিকে নতুন করে কল্পনা করতে হবে।

আজকের বিশ্বে একটি দেশের মর্যাদা শুধু জিডিপি বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে বিচার করা হয় না। বিচার করা হয় এই প্রশ্নে—রাষ্ট্র তার নাগরিকদের, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের, কতটা সুরক্ষা দিতে পারে। সেই বিচারে অভিবাসন নীতির উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য কেবল অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়; এটি একটি নৈতিক ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর