দক্ষিণের মফস্বল জনপদ ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে এসেছেন শরিফ ওসমান হাদী। তিনি কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। বরং দেশের রাজনৈতিক উত্তাল সময়, সামাজিক বাস্তবতা এবং সময়ের অভিঘাতের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি সাহসী সামাজিক-রাজনৈতিক কণ্ঠ। ভক্তরা তাকে সাহসী, আপসহীন ও জননেতা বলেই মনে করেন। সমালোচকরা বলেন, সীমা অতিক্রমকারী, উসকানিদাতা। এই দ্বন্দ্বই হাদীকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছে; তাকে কোনোভাবে উপেক্ষা করা যায় না।
হাদীর পারিবারিক পটভূমি তার চিন্তার ভিত গড়ে দিয়েছে। তিনি একজন মাদ্রাসা শিক্ষকের সন্তান। বাবা মাওলানা শরীফ আবদুল হাদী ছিলেন নলছিটি উপজেলার একজন সম্মানিত আলেম। পরিবারে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, ধর্মীয় চেতনা এবং পরিপাটি জীবনধারার শিক্ষা ছিল শক্ত ভিত্তি। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত হাদীর জীবন ঘেরা ছিল এই আদর্শে। তার পরিবারে নারীরা কঠোর হিজাব ও নিকাব মেনে চলতেন, যা হাদীর মধ্যে ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছিল। প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি পড়াশোনা করেন দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝালকাঠির নেছারাবাদ কামিল মাদরাসায়। এখান থেকেই তার চিন্তার ভিত গড়ে ওঠে- ইসলামি মূল্যবোধ, ইতিহাসচেতনা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মানসিকতা। ছোটবেলা থেকেই হাদি বক্তৃতা দিতে, মিছিলে অংশ নিতে এবং সামাজিক বিষয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে অভ্যস্ত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও বিস্তৃত হয়। রাষ্ট্র, ক্ষমতা, গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক ন্যায়— এই ধারণাগুলোকে একাডেমিকভাবে বোঝার সুযোগ তিনি পান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেও নিজেকে যুক্ত করতে শুরু করেন। পড়াশোনা শেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগও ছিল, যা নিরাপদ ও স্থিতিশীল জীবন নিশ্চিত করত। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, জুলাই অভ্যুত্থানের ধাক্কা এবং জনসচেতনতা তার নিরাপত্তার বৃত্ত ভাঙতে বাধ্য করে। স্রোতের বিপরীতে কীভাবে চলতে হয়, কীভাবে মনের অব্যক্ত ভাষাকে কথামালায় রূপান্তর করতে হয়— হাদী আমাদেরকে তা দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্যাসিবাদের শিকড়ে আঘাত হানতে হয়, কীভাবে চারপাশে সুশীলের মুখোশ পরা শুয়োরগুলোর চরিত্র উন্মোচন করতে হয়। বাতিলের বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রেরণার নাম আমাদের প্রিয় ভাই শরীফ ওসমান হাদী।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাদি গঠন করেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ।’ এটি প্রচলিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং প্রতিরোধের একটি প্ল্যাটফর্ম। ইনকিলাব মঞ্চের লক্ষ্য— সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ। ভারতের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া, জনগণের সার্বিক অধিকার, দেশের স্বকীয়তা ও জাতীয় নীতির প্রতি অঙ্গীকার— এই সবকিছুকেই হাদী ইনকিলাব মঞ্চের মূল প্রতিপাদ্য করেন। হাদীর আহ্বান এবং সমাবেশগুলোতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। শাহবাগে অনুষ্ঠিত সমাবেশগুলো ছিল বিশেষভাবে প্রতীকী। এখানে তিনি দাবি তুলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের স্বীকৃতি, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ। মিডিয়ায় উপস্থিতি বাড়ার পর হাদি টকশোতে ডাক পান। শুরুতে মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য রাখলেও পরবর্তীতে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। ভক্তরা তাকে সাহসী ও আপসহীন বলে প্রশংসা করেছেন; সমালোচকরা বলেছেন, ভব্যতার সীমা অতিক্রম করছেন। কিন্তু এই দ্বন্দ্বই তাকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছে।
হাদীকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা সীমিত নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে এসে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে। হামলার মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। এখন তিনি লাইফ সাপোর্টে হাসপাতালে। বিএনপি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল এটিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে।
ওসমান হাদীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়— নলছিটির মাদ্রাসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষকতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজপথ— একটি প্রশ্ন সামনে তুলে দেয়: রাজনীতি কি শুধু দল, ক্ষমতা এবং ভোটের খেলা, নাকি এটি আদর্শ, ন্যায় এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়ও?
তাগুতের উত্তরসূরী শুয়োরগুলো ভেবেছে এক হাদীকে হত্যা করলেই ওদের পথে আর বাধা থাকবে না। কিন্তু তারা জানে না, হাদীরা কখনো মরে না। হাদী ভাই আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন ইনশাআল্লাহ। তিনি ময়দানে ফিরে এসে দেখবেন অসংখ্য যুবক তার রেখে যাওয়া কাজগুলো সম্পাদন করছে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম হাজারো হাদি তৈরি হতে থাকবে।
আজ গুলিবিদ্ধ হয়ে লাইফ সাপোর্টে থাকা হাদী কেবল একজন আহত তরুণ নয়। তিনি একটি ধারার প্রতীক— যে ধারা রাষ্ট্রকে নতুন করে ভাবতে চায়, কঠিন সত্য বলার সাহস রাখে। তার রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভিন্নমত এখনো এই দেশে নিরাপদ নয়। কিন্তু একই সঙ্গে সত্য হলো, এই কণ্ঠগুলোই ইতিহাসে দাগ কাটে। হাদী জিতছেন নৈতিক উচ্চতায়; আমরা হেরে যাচ্ছি সুবিধা, নিরাপত্তা এবং স্বস্তির বৃত্তে। নলছিটি থেকে উঠে আসা এই কণ্ঠ ইতোমধ্যেই জাতীয় রাজনীতিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তার যাত্রা কবে থামবে, তা এখনও অজানা। তবে নিশ্চিত, এই কণ্ঠ ইতিহাসের পাতা কাঁপাবে, এবং নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে থাকবে। যাদের শরীরে শহীদের রক্ত প্রবাহিত, যারা শাহাদাতের তামান্নায় সর্বদা বিভোর, তারা কি হেরে যেতে পারে? না, কখনোই না। বিশ্বাসীদের জীবনে কোনো পরাজয় নেই। শহীদের প্রজন্ম আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তিকে পরোয়া করে না। আমরা ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে দ্বিগুণ হয়ে উঠবো এবং বাতিলের শিকড়ে তুমুল বেগে আঘাত হানতে থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের দিকে।
কবি আল মাহমুদের ভাষায়—
‘আমরা তো শাহাদাতের জন্যই মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে পা রেখেছি।
কেউ পাথরে, কেউ তাবুর ছায়ায়, কেউ মরুভূমির উষ্মবালু কিংবা সবুজ কোন ঘাসের দেশে।
কে প্রশ্ন করে আমরা কোথায় যাবো?
আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।’
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট ও সংগঠক