বাংলাদেশ তার উন্নয়নযাত্রায় এক ঐতিহাসিক মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সুবিধা পেয়ে আসার পর অবশেষে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগোচ্ছে। উন্নয়ন অর্জনের এই স্বীকৃতি জাতীয় গর্বের বিষয় হলেও সামনে রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৫৪ শতাংশই যায় ইইউ দেশে, যার সিংহভাগই তৈরি পোশাক। এই অবস্থায় এলডিসি সুবিধা শেষ হলে ইইউ বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখা, জিএসপি সুবিধা ধরে রাখা, নতুন বাণিজ্য শর্ত মানা এবং দক্ষ কূটনীতি পরিচালনা সবকিছুই হয়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় কৌশলের এক বড় পরীক্ষা।
গত এক দশকে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য বৃদ্ধি হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ইইউতে রপ্তানি করেছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন ইউরো, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ইউরোতে। রপ্তানির ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক, আর বাকি অংশে রয়েছে হোম-টেক্সটাইল, ফুড প্রসেসিং, লেদার এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য। ইইউ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী কিন্তু একই সঙ্গে তারা শ্রমমান, মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশকে আর আগের মতো শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেওয়া হবে না। এসময় বাংলাদেশকে ইইউ’র নতুন জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রিফারেন্সেস (জিএসপি প্লাস)–এর কঠোর শর্ত পূরণ করতে হবে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক কীভাবে ভারসাম্যে রাখা যাবে? কূটনৈতিক প্রভাব কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? আর রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি কীভাবে ঝুঁকি মোকাবিলা করবে?
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোটেও সহজ নয়। ইইউ বাজারে এলডিসি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ এখন ‘Everything But Arms’ (EBA)–এর অধীনে শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু স্নাতকোত্তর হওয়ার পর দেশটি জিএসপি প্লাস সুবিধা পাবে কিনা—তা নির্ভর করবে ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নের ওপর। যার মধ্যে রয়েছে শ্রম অধিকার, শিশু শ্রম নিরসন, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি দমন, জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা প্রভৃতি মানদণ্ড। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশেষত রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শ্রমমান বিষয়ে যে কঠোর ভূমিকা নিয়েছিলো, তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শ্রম আইন সংস্কার, ফ্যাক্টরি পরিদর্শন জোরদার এবং বাণিজ্য চেম্বারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হলে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো, সেফটি কমপ্লায়েন্স—এসব বিষয়ে উন্নতি যত দ্রুত দৃশ্যমান হবে, ততই বাংলাদেশের পক্ষে জিএসপি প্লাস পাওয়া সহজ হবে।
এখানে কূটনৈতিক দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ-এর নীতিনির্ধারকরা অনেক সময় বাংলাদেশের বাণিজ্য অংশীদারদের মতামত শোনেন, আবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’—যেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং প্রবাসী দূতাবাস একসঙ্গে কাজ করতে পারে। কেবল সরকারি চিঠি আদান–প্রদান বা আনুষ্ঠানিক বৈঠক না করে একটি পরিপূর্ণ লবিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং প্রধান প্রধান ক্রেতা গোষ্ঠী—সবক’টির সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
স্নাতকোত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো শুল্ক। জিএসপি প্লাস না পেলে বাংলাদেশের পোশাকে প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক বসবে, যা রপ্তানি প্রতিযোগিতায় ভীষণ প্রভাব ফেলবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশই ইতোমধ্যে ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে শুল্ক সুবিধা নিশ্চিত করেছে। তাদের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লে বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই রপ্তানি কৌশলের দিক থেকে এখনই নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো জরুরি।
আমাদের রপ্তানি অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকনির্ভর। ইইউ রপ্তানির ৯০ শতাংশই একটি সেক্টর থেকে আসা অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। এলডিসি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যদি খাদ্যপণ্য, আইটি সেবা, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য বা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য ইইউ বাজারে প্রবেশ করাতে পারে তাহলে সামগ্রিক ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। কিন্তু এসব সেক্টর এখনও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ইউরোপের কঠোর মানদণ্ড, সার্টিফিকেশন, সেনিটারি ও ফাইটো-স্যানিটারি প্রয়োজনীয়তা—এসব মেনে চলা ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন। সরকারকে এই সেক্টরগুলোতে টেস্টিং ল্যাব, টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সার্টিফিকেশন গাইডলাইন এবং নীতিগত সহায়তা দিতে হবে।
ইইউ’র সাপ্লাই চেইন এখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কার্বন ট্যাক্স, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবাধিকার নিশ্চয়তা এবং সাপ্লাই চেইন ডিউ ডিলিজেন্স আইনের আওতায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহকারীকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করছে। বাংলাদেশের পক্ষে এটি চ্যালেঞ্জ। যদি আমরা গ্রিন–ইন্ডাস্ট্রি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও সাসটেইনেবল প্রোডাকশনে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে ইউরোপে ‘সাসটেইনেবল সোর্সিং’–এর জন্য বাংলাদেশ আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং নীতিগত উদ্ভাবন।
তাছাড়া, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যকে আলাদা বাজার হিসেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সেখানে ডেভেলপিং কান্ট্রি ট্রেড স্কিম পেয়েছে, যা ২০২৯ পর্যন্ত নিশ্চিত। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি ও যুক্তরাজ্যের নতুন স্কিম—দুটি ভিন্ন কাঠামো। ফলে দুই বাজারের জন্য আলাদা রপ্তানি পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি। আমাদের দূতাবাস ও কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের এই বিষয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। ‘বাণিজ্যিক কূটনীতি’কে শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব কাজে রূপ দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—বাংলাদেশ কীভাবে ইইউ’র সঙ্গে তার বাণিজ্য সম্পর্ক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে? প্রথমত, আমাদের উচিত বাস্তবতা মেনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া। এলডিসি সুবিধা চিরস্থায়ী নয়, এটি শুরু থেকেই জানা। তাই স্নাতকোত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে ‘বাজার ধরে রাখার’ মনোভাব ছেড়ে ‘মূল্য সংযোজন বাড়ানোর’ দিকে যেতে হবে। শুধু সস্তা শ্রম নয়—দক্ষ শ্রম, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, স্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পই আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করবে।
দ্বিতীয়ত, ইইউ’র সঙ্গে একটি কৌশলগত ‘বাণিজ্য সংলাপ’ শুরু করতে হবে। সময়মতো অগ্রগতি রিপোর্ট, আইন সংশোধনের রোডম্যাপ, শ্রম অধিকার বাস্তবায়নের প্রমাণ—এসব ইইউ কমিশনের কাছে নিয়মিতভাবে পাঠাতে হবে। কোনো নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই কূটনৈতিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ নীতি দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য। রপ্তানিকারকদের জন্য সার্টিফিকেশন, কাস্টমস কার্যপ্রণালী, বন্দর দক্ষতা, শ্রম আইন বাস্তবায়ন—এসব বিষয়ে সমন্বিত নীতি না থাকলে কোনো আন্তর্জাতিক সুবিধাই কাজে আসবে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এবং ব্যবসায়ের সময়সীমা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি।
চতুর্থত, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা ছাড়া কোনো দেশ দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে খাদ্যপণ্য, ওষুধ, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং—এসব খাতে বাংলাদেশ নতুন সুযোগ পেতে পারে। সরকারের উচিত এসব সেক্টরকে ‘স্পেশাল ফোকাস ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে ঘোষণা করা।
সবশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই দৃঢ় কূটনীতি, দ্রুত সংস্কার এবং রপ্তানি কৌশলের সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে তবে এলডিসি স্নাতকোত্তর পরবর্তী সময়টি শুধু চ্যালেঞ্জ না, সুযোগেও পরিণত হতে পারে। আমরা যে পথেই হাঁটি না কেন, বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী দশকে ইইউ বাজারের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল থাকবে। তাই এই সম্পর্ককে আরও টেকসই, পরস্পর–সহযোগিতামূলক এবং কৌশলগত করতে হলে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নের একটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। সামনে পথ আরও কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কূটনীতি, দক্ষ জনশক্তি এবং রপ্তানি কৌশল—এই ভিত্তি যদি আমরা দৃঢ় করতে পারি, তবে এলডিসি স্নাতকোত্তর পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে টিকে থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট