শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করে। এক সময় সে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ পাড়ি দেয়। এই জন্য তাকে দীর্ঘ ১২ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে উত্তীর্ণ হতে হয়। বাংলাদেশে মানুষের স্বাক্ষরতার হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান কতটুকু উন্নতি লাভ করেছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলেও সুশিক্ষিত লোক পাওয়া মুশকিল। এখানে প্রচলিত ধারায় লেখাপড়া করানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে একাডেমিক ডিগ্রি (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) প্রদান করা হয়। এটি এমন একটি স্থান যেখানে জ্ঞান সৃষ্টি, চর্চা এবং সঞ্চালনের কাজ করা হয়, এবং এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি সম্প্রদায় হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক পরিচালিত ও অনুমোদন প্রাপ্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু ডিগ্রি অর্জন নয়, কতগুলো সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সুতরাং মেধাবী শিক্ষার্থীরাই সেখানে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে সুশিক্ষিত শিক্ষার্থী বিরল। ফলে নামমাত্র শিক্ষিত মানুষ পাওয়া গেলেও যথার্থ ফলাফল হচ্ছে না।
এমন সমস্যার উল্লেখযোগ্য কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান না থাকা। প্রতিনিয়ত দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে। কিন্তু পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যেক শিক্ষার্থী। সুতরাং একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক ও পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও ল্যাব সুবিধা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকটাপন্ন। আধুনিক সরঞ্জাম, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি ছাড়া বর্তমান বিশ্ব অভাবনীয়। ইন্টারনেট সংযোগ দেশ বিদেশের বিভিন্ন জ্ঞান শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য সাহায্য করে। এছাড়া লাইব্রেরিতে যথেষ্ট উপকরণ থাকা জরুরি। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়ক গবেষণা। কিন্তু গবেষণার জন্য যথেষ্ট ফান্ড ও ল্যাব উপকরণ দরকার। সরেজমিনে দেখা যাবে ৫/৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই। প্রতি বছর এমন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো শিক্ষার নামে বাণিজ্য হয়ে থাকে। শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত নাই, শিক্ষক নাই, তবুও কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে। উল্লেখ্য স্নাতকের মেয়াদ চার বছর থাকলেও ৫/৬ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আবাসন হল শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যাবশ্যক। হলের সুবিধাজনক রুম সংখ্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ক্যান্টিন, ডাইনিং, রিডিং রুম, বিনোদন রুম ইত্যাদি দরকার। কারণ শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকে না। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় একজন শিশু সমাজের নানা জায়গা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে কোনো আবাসিক হল নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা উদ্বাস্তু জীবনযাপন করে। তারা রুম বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। কোনো বাসায় ২/৪ মাস আবার কখনো দীর্ঘ দিন থাকতে হয়। এতে তারা নানা ধরনের সমস্যায় পড়ে। বিদ্যুৎ, গ্যাস সময় মত থাকে না। মেসে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত বাজার করা লাগে। মাস শেষ হলে বাড়িওয়ালার অকথ্য ভাষায় কথা তো শুনতে হয় বাসা ভাড়া নিয়ে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনো উন্নতি হয় না। মেসে পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ, রুমে টেবিল-চেয়ার থাকে না। ছোট রুমে অনেক মানুষ থাকতে হয়। অথচ এই সময় ছিল তাদের পড়াশোনার জন্য ব্যয় করা।
এমন হাজারো সমস্যা থাকা স্বত্তেও তাদের টিউশন চার্জ বেশি দিতে হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ নেই। কিন্তু নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকের বেতন ঠিকই বাড়লেও তারা আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। নানা কারণে মানুষের শরীর খারাপ হতে পারে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার গেলে নাপা, প্যারাসিটামল ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। প্রতিনিয়ত এমন সমস্যা মোকাবিলা করে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই তাদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেন্টার রাখতে হবে। এছাড়া শরীরচর্চা মানুষের মন সজীব ও সতেজ রাখে। দেহের বিভিন্ন রোগ থেকে বিরত রাখে। তাই স্পোর্টস সেন্টার, জিম থাকা দরকার।
বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে থেকেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও ক্যাম্পাস ওয়াই-ফাই নেই। শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি শেষ করে বিভিন্ন সার্টিফিকেট তুলতে লাইন দিতে হয়। কিন্তু এই জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, রেজাল্টের ব্যবস্থা করতে পারে। উচ্চমানের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার করে ই-লার্নিং কার্যক্রম করা যায়।কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সীমাবদ্ধ থাকে পাঠ্যপুস্তকে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট আবাসিক হল সুবিধা নেই সেখানে পরিবহন সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং তাদের কল্যাণে পর্যাপ্ত বাস সার্ভিস, নিরাপদ ও সময়ানুবর্তী পরিবহন, দূরবর্তী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ রুট প্রয়োজন থাকলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ব্যর্থ। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রয়োজন। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা, যৌনহয়রানি প্রতিরোধ সেল, র্যাগিং-বিরোধী কমিটি, রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি প্রয়োজন। তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন ক্লাব, কমিটি গঠন করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডিবেট, কালচারাল ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক সময় তাদের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চলে আসে। তাই ক্যারিয়ার গাইডেন্স সেন্টার, চাকরি মেলা, ইন্টার্নশিপ সহযোগিতা,
বিদেশে স্কলারশিপ ও রিসার্চ অ্যাপ্লাই সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থী-বান্ধব নীতিমালা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিই পারে তাদের সমস্যার কথা অনুধাবন করতে। অন্যথায় তাদের সমস্যা প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।
উল্লেখ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে রাজপথে আন্দোলন করে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার শিকার হয়। অথচ এখন সময় ছিল তাদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা। ঢাকার কেরাণীগঞ্জে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হওয়ার কথা থাকলেও কাজের অগ্রগতি নেই। পুরান ঢাকার মত পরিবেশে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। তারা তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ঝুকিপূর্ণ ভবনে এখনো ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়।
অন্যদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই সমস্যায় জর্জরিত। তারা ক্লাস, পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষক শিক্ষার্থী মিলে আন্দোলন করছে। তাদের অনেক বিভাগের নিজস্ব ক্লাস রুম নেই। তারা শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে ক্লাস কার্যক্রম করছে, আবাসিক সুবিধা তো দূরের কথা। তাদের জন্য একটা লাইব্রেরি থাকলেও যথেষ্ট উপকরণ নেই। লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই নেই। যার কারণে অনেকে একসাথে একই বই পড়ার সুযোগ পায় না। বই ধার নেওয়ার যে একটা রেওয়াজ লাইব্রেরি থেকে, সেটাও নেই। কোন বই বাসায় আনা যায় না। আর ক্যান্টিনে মাঝে মাঝে খাওয়ার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় শিক্ষক রা গেছেন সবাই। ওনাদের জন্য শিক্ষার্থীরা জায়গা পাচ্ছে না। ল্যাব আছে একটা তার কয়েকটা কম্পিউটার মাত্র তাও অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
এমন সমস্যায় জর্জরিত বরিশাল, নেত্রকোনা, মেহেরপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে শিক্ষার্থীরা তারা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সুযোগ সুবিধা দিতে ব্যর্থ। সুতরাং এত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না করে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তাদের জন্য সবচেয়ে কম বাজেট রাখা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে বৈষম্যের শিকার দেখা যায়। সুতরাং প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত বাজেট দিয়ে উন্নয়ন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়