দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। গতবারের মতো এবারও ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক। হাসপাতালে আসা ব্যক্তিদের তথ্যও অনেক। অনেকে ঘরে বসে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে তাদের তথ্য উঠে আসছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বুলেটিনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬, সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ এবং এ মাসের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ হাজার ২৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে মূলত দুই ধরনের সংক্রমণ হয়—সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ও মারণাত্মক ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রূষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবু মৃত্যু ঘটছে। কারণ, আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা-পরবর্তী সময়ে) এ রোগের ভাইরাস মশা দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ডেঙ্গু রোগের সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনো সেভাবে আবিষ্কার হয়নি, তাই মশকনিধনযজ্ঞ বিনা আর উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের সব সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে, এটি যেন আমাদের এক অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর দেশের প্রায় ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বছর দুয়েক আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ও বিস্তার ছিল কেবল বর্ষাকালেই, কিন্তু আবহাওয়াজনিত কারণেই হোক বা অন্য কারণ, ডেঙ্গু এখন পত্রিকার শিরোনাম অনুযায়ী বারোমাসি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশাবাহিত এই রোগ এখন কোভিডের থেকেও যেন বেশি আতঙ্কের বিষয়, কিন্তু সরকার বা সিটি কর্পোরেশনগুলো অনেকটাই নির্বিকার। এবার লক্ষণীয় দিকটি হলো, রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যত্র ডেঙ্গু বিস্তারের পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানীতে মশা নিধনে কিছুটা হলেও একটা ব্যবস্থা আছে; কিন্তু ঢাকার বাইরে তা-ও নেই। আর চিকিৎসা পরিকাঠামোর কথা নাই বা বললাম।
দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে রাস্তাঘাট আবর্জনামুক্ত করা, ভাঙা সড়ক ও বসতবাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, মশার বংশবৃদ্ধিরোধক কীটনাশক প্রয়োগ, নাগরিকদের সচেতন করার মতো প্রাথমিক কাজগুলো স্থানীয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশনগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। উল্টো সরকার ও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়শই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নাগরিকদের অসচেতনতাকেই দায়ী করে নিজেদের দায় সারেন। তাদের অনেকের ভাষ্য মতে, সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ নিজের বাড়ির ভেতরে গাছের টব ইত্যাদির জমা পানি পরিষ্কার করছে না। ফলে মশা সেখানে নির্দ্বিধায় বংশ বিস্তার করতে পারছে।
এই যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তা মোকাবিলায় সরকারের স্বাস্থ্য সেবা খাত আসলে কতটা প্রস্তুত? বিগত বছরের গাফিলতি ও ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও হাসপাতালগুলো আদৌ সতর্ক, সচেতন ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নাকি ডেঙ্গু পরীক্ষার যথাযথ ব্যবস্থাই নেই। অবশ্য যুগ যুগ ধরে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটা বড় সমস্যা। নব্বই দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো স্বল্প শয্যা থেকে অবস্থানভেদে কোথাও কোথাও ১৫০ থেকে ২০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে, যাকে আমরা উন্নতি হিসেবেই দেখেছি; কিন্তু অবকাঠামো হলেই তা যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি বলে মনে হয় না। কেননা, দেখা গেছে, অবকাঠামো বাড়ানো হলেও জনশক্তি প্রায় জায়গাতেই আগের শয্যা অনুসারেই রয়ে গেছে। আমরা প্রায়শই দেখতে পাই, দক্ষ জনশক্তির অভাবে সরকারি বড় হাসপাতাল আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে টেকনিশিয়ানের অভাবে বিভিন্ন মেশিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে; কিন্তু চালক নেই, কোথাও টেকনিশিয়ান আছে অথচ সংশ্লিষ্ট মেশিন নেই- এমন আরও নানা সমস্যা। রোগীরা সেসব যন্ত্রের সেবা নিতে না পেরে বেশি দামে বাইরে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছে।
অর্থাৎ অবকাঠামো বাড়ানো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জনশক্তি বা পরিকাঠামো বাড়ানো হয়নি। এতে আমরা দেখাতে পাচ্ছি, হাসপাতাল ভবন হয়েছে; কিন্তু আদতে সেখানে যথাযথ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, হয়তো কোনো হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন; কিন্তু ডিগ্রিধারী নার্স, সাপোর্ট ফোর্স বা আইসিইউ-সিসিইউ সাপোর্ট নেই। এভাবেই চলছে, আর আমরাও নির্বাক ও নির্লিপ্ত! ভুলে গেলে চলবে না, স্বাস্থ্য খাত এমন একটি খাত, যেখানে সামান্য ভুল অসামান্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার সঙ্গেও ডেঙ্গু বিস্তারের যোগসূত্র থাকতে পারে। এর একটা কারণ সড়ক ও বাসাবাড়ির পাশে জমে থাকা জলাবদ্ধতা, আর এটাই এডিস মশা প্রজননের জন্য আদর্শ। তাই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশাকে প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ সচেতনতা গড়ে তোলাটাই এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্বে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে এর উল্টো চিত্র। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের চেয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন গুণ বেশি; মৃত্যুর সংখ্যাও অধিক। যদিও সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার গত বছরের চেয়ে কম হলেও তা এখন বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার বাংলাদেশে। যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন নেই, কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে, তাহলে এই রোগে মৃত্যু কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যেকোনো দুর্যোগ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা মানুষকে অভিজ্ঞ করে, তা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, যাতে করে ভবিষ্যতে এমন যেকোনো দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যে অভিজ্ঞতা আমাদের অর্জিত হয়েছিল, তা থেকে আমরা আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছি কি না তা একটি বড় প্রশ্ন। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে ডেঙ্গু মোকাবিলার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুমুক্ত করার কাজ শুধু সিটি করপোরেশন ও সরকারের একার নয়, সাধারণ নাগরিককেও সচেতন হতে হবে। তবে তার জন্য আমাদের সবাইকেই দায়বদ্ধ হতে হবে, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতি মেনে চলতে হবে, তাহলেই ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি মোকাবিলা আমাদের জন্য সহজতর হবে।
কারণ, মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশক নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়া। জনসচেতনতার অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও ডেঙ্গু বিস্তারে ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণের নীতি ও রূপরেখায় এবং নগর পরিচালনায় জনস্বাস্থ্যের দিকটি আমাদের দেশে অত্যন্ত অবহেলিত। যেকোনো মশাবাহিত রোগের উৎপত্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক, কারণ শহরের জনবহুল, ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার পরিবেশ মশা জন্মানো ও দ্রুত রোগ সংক্রমণের জন্য আদর্শ। ডেঙ্গু রোধেও তাই জনস্বাস্থ্যমুখী নগর-পরিকল্পনা ও পরিচালনা পদ্ধতি থাকা চাই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। এখন তা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। জনস্বাস্থ্য সেখানে উপেক্ষিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়। এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উল্লিখিত সব স্থান, সেপটিক ট্যাংক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুর মৃত্যুমিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং জনগণ ও সিটি করপোরেশন—উভয়েরই সমান সচেতনতা জরুরি।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক