খুব ছেলেবেলা থেকেই আমাদের সমবয়সী অনেকের সাথেই পরিচয় ঘটে। তবে কারও কারও সাথে থাকে একটু বেশি ঘনিষ্টতা। কালক্রমে সেই ঘনিষ্টতার নাম হয় বন্ধুত্ব। যদিও বন্ধুত্ব এত ছোট পরিসরে ব্যবহার করা যায় না। তারপরও এই সম্পর্ককে বন্ধুত্বই বলা চলে। তারপর যখন আবার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন অনেকের সাথে পরিচয় ঘটলেও এখানেও অল্প কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাকেও আমরা বন্ধুত্ব বলি। এটাও সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়। চূড়ান্তভাবে দু’চারজন টিকে থাকে বন্ধু হিসেবে। বাকিরা থাকে স্মৃতির পাতায়। অবশ্য আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুর অভাব নেই। তবে সেই বন্ধুর সাথে আমাদের আতিœক বন্ধুর কোনো তুলনা নেই। যে বন্ধু বিপদে কাজে আসে না তাকে বন্ধুত্ব না বলাই উত্তম। সেই ভালুকের গল্পের মত। প্রযুক্তির এই যুগে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারও এক হাজার, কারও দুই হাজার আবার কারও তার চেয়েও বেশি। কেউ আবার কিছুদিন পরপরই বন্ধুর তালিকা থেকে কাউকে মুছে দিচ্ছে। এই তো হালের ডিজিটাল বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব হতে যেমন সময় লাগে না আবার ভাঙতেও সময় লাগে না। এখানে বন্ধুত্ব হয় স্বার্থে! অথচ একজন প্রকৃত বন্ধু পেতে যেমন সময় লাগার কথা, বন্ধুত্ব ভাঙতেও সময় লাগার কথা।
বন্ধু কখনো বন্ধুকে ছেড়ে যায় না। আর তাই ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচিতজনের তালিকায় থাকা কে বন্ধু আর কে অবন্ধু তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। কারণ এসব বন্ধুত্ব যেমন হয় মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেভাবেই আবার বন্ধুত্ব বাতিলও করা যায়! আবার বন্ধুর ছদ্মবেশে আসলে কে আমার পাশে আছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। অথচ একজন প্রকৃত বন্ধু একটি জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে। আর বন্ধু শত শত বা হাজার হাজার হওয়ার কোনো দরকার নেই। দু’চারজন হলেই তা যথেষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো কে বন্ধু হতে পারে? এর উত্তর হলো- মা,বাবা,ভাই বা বোন থেকে শুরু করে শিক্ষক বা অন্য যে কেউ বন্ধু হতে পারে। একজন মা তার সন্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে। আজকাল তো সেই পরামর্শই দেওয়া হয়। আর বাইরের যারা বন্ধু হয় তাদের কতজন শেষ পর্যন্ত মনে রাখে তা তো আমরা জানি। আবার বন্ধুর নাম ধরে বন্ধুর বুকে ছুরি মারার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
আমরা তাকেই বন্ধু বলি যে আমার পাশে থেকে আমাকে উৎসাহ,অনুপ্রেরণা,ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং বিপদে এগিয়ে আসে। যদিও এতকিছু আজকাল তেমন কেউ করে না। তারপরও তাকেই বন্ধুত্ব বলা যায়, নচেৎ নয়। পরিচিত মাত্রই আমরা তাকে বন্ধুত্ব বলতে পারি না। একক্লাসে পড়ালেখা করলেও সে বন্ধু হয় না, ক্লাসমেট হয়। আর বন্ধু হতে হলে এক ক্লাসে পড়ার দরকার নেই, এক পাড়ায় থাকার দরকার নেই। দরকার কেবল অন্তরের আকুলতা। যাকে ভালোবাসাও বলা যায়। প্রকৃত বন্ধুত্ব ভালোবাসতে শেখায়, ঘৃণা করতে নয়।
এই যে আজ আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হাজার হাজার বন্ধু, আমি একটি পোষ্ট দিলেই শত শত লাইক কমেন্টেসে ভরে উঠছে। শুভকামনা দেওয়ার হিড়িক পরছে। এসবকেই বন্ধুত্ব ভাবছেন? তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে আছেন। বন্ধুত্ব এত সহজও নয়। আপনার শূণ্যতা কারও অনুভূত হচ্ছে কি না, কেউ আপনাকে ভাবছে কি না বা আপনার অনুপস্থিতি কারও মনে দাগ কাটছে কি না সেটা বিবেচনা করতে হবে। বুঝবেন সেই আপনাকে বুঝতে পারে অর্থাৎ বন্ধু হতে পারে। সবাই বন্ধু হতে পারে না। শত্রু হওয়া যতটা সহজ ব্যাপার বন্ধুত্ব ততটাই কঠিন। বন্ধু হতে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।
বন্ধু হবারও যোগ্যতা থাকা দরকার। এই যোগ্যতা কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেটের যোগ্যতা নয়। এই যোগ্যতা কাছে আসার যোগ্যতা, অন্যকে বোঝার যোগ্যতা, ভালোবাসার যোগ্যতা এবং সর্বোপরি বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার ও বিশ্বাস করার যোগ্যতা। এত এত যোগ্যতা আজ আর ক’জনের মধ্যেই বা আছে। তাই অল্পতেই আজকাল বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। বিশ্বাসের অবনমন ঘটে। অথচ এই বিশ্বাসের ওপরই বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত হয়। যার বন্ধুর ওপর বিশ্বাস যত বেশি তারা তত ভালো বন্ধু। আমাদের কজনেরই বা আজ সে যোগ্যতা রয়েছে। আমরা তো কেবল স্বার্থ নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। স্বার্থ ফুরালে চম্পট দেই। বন্ধুত্বের সুযোগে আঘাত করি। কিন্তু এই সমাজকে বাঁচাতে আজ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের খুব দরকার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধুর প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। তখন মানুষ হয় নিঃসঙ্গ। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন সময় সাহচর্য পাওয়া বন্ধুরা তখন কে কোথায় থাকে তা জানাও যায় না। অন্তর দিয়ে কেবল সে সময়ের স্মৃতি হাতরানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মনের কোণে সেই গান গুণ গুণ করে বাজে, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই’।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট