Thursday 23 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রায় হয়েছে ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে, ভাড়ায় কারাগারে মাদকাসক্ত রিকশাচালক

ডিস্ট্রিক্ট করেসপনডেন্ট
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০৪

সেলফি মুডে ইউপি সদস্য সেতাউর রহমান ও পুলিশ হেফাজতে মাদকাসক্ত রিকশাচালক মিঠুন।

রাজশাহী: আদালতে কারাদণ্ড হয়েছে সেতাউর রহমানের (৩৯)। কিন্তু সেতাউর সেজে কারাগারে সাজা খাটছেন মিঠুন (৩২) নামের আরেকজন। বাংলা থ্রিলার ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার মতো চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

একটি রিকশা আর কিছু টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মাদকসেবী মিঠুনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সেতাউর রহমান। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। সেতাউর তার নিজ এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

এই মামলার কারাগারে ভাড়া খাটা আসামিকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাজশাহী মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক বেগম লুনা ফেরদৌস এ নির্দেশ দেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার বাদীর আইনজীবী নুরে আলম। তিনি জানান, রাজশাহী মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক কারাগারে থাকা আসামিকে স্বশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কবে হাজির হবে এমন তারিখ জানাতে পারেননি এই আইনজীবী।

সেতাউরের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামে। তিনি কানসাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। শিবগঞ্জে তার বেকারি কারখানা রয়েছে। মিঠুনের বাড়িও বিশ্বনাথপুর গ্রামে। গত আড়াই মাস ধরে তিনি সেতাউরের হয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

মামলার নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর বায়া এলাকার এফএম অটোরাইস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্বাধিকারী মো. আজিজ ৭০ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির অভিযোগে সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। গত বছরের ১৮ এপ্রিল রাজশাহীর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মোছা. রুবিনা পারভীন ওই মামলার রায়ে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি তাকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

মামলার রায় ঘোষণার সময় আসামি সেতাউর পলাতক ছিলেন। এরপর গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিঠুনকে আসামি সেতাউর সাজিয়ে রাজশাহীর আদালতে আত্মসমর্পণ করানো হয়। আদালতকে মিঠুন তার নাম জানান সেতাউর। পরে আদালত তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান।

এদিকে সেতাউরের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকার চেক জালিয়াতির অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি মামলা করেছিলেন আবদুল মালেক নামের এক ব্যক্তি। আবদুল মালেক নিজেই একজন আইনজীবী। তার মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন সেতাউর। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সেতাউর তাকে টাকা পরিশোধ করেননি। ফলে আবদুল মালেক বিষয়টি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুগ্ম দায়রা জজ আদালত-২-এর নজরে আনেন।

সম্প্রতি তিনি আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিরও আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে শিবগঞ্জ থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠান। পরবর্তীকালে আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় আইনজীবী আবদুল মালেক শিবগঞ্জ থানায় যান। তখন পুলিশ তাকে জানায়, মালেকের মামলার আসামি অন্য আরেক মামলায় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী।

এতে সন্দেহ হয় আইনজীবী মালেকের। তিনি কারাগারে থাকা আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য আবেদন জানান। সে অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে আসামি সেতাউর হিসেবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিঠুনকে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ সময় আইনজীবী আবদুল মালেক আইনজীবীকে জানান, এই আসামি সেতাউর নয়। তিনি অন্য কেউ। এ সময় মিঠুনও আদালতে স্বীকার করেন যে তিনি সেতাউর নন। টাকার লোভে তিনি সেতাউর সেজে কারাগারে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেতাউর তাকে শুধু কারাগারের পিসি বইতে ছয় হাজার টাকা দিয়েছেন। আর কোনো টাকা তাকে দেওয়া হয়নি।

আইনজীবী আবদুল মালেক বলেন, আদালত নিশ্চিত হয়েছেন যে অন্য মামলায় সেতাউর সেজে মিঠুন কারাগারে জেল খাটছেন। এ কারণে তাকে আমার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। মিঠুনকে আবার কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনো কারাগারে।

মিঠুনের স্ত্রী আশা খাতুন জানান, তার স্বামী মাদকাসক্ত। স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ নেন না। তাই তিনি বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি শুনেছিলেন, তার স্বামী কারাগারে আছেন। কিন্তু কোন মামলায় তা জানতেন না। বৃহস্পতিবার জেনেছেন, সেতাউর সেজে তিনি কারাগারে। তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মিঠুন এ সময় তাকে বলেন, কারাগারে থাকলে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে সেতাউর তাকে এখানে পাঠিয়েছে। কিছুদিন পর তাকে বের করা হবে। কারাগারে নিয়মিত টাকা দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কারাগার থেকে বের হলে একটি রিকশা দেওয়ার লোভও তার স্বামীকে দেখান সেতাউর।

আশা বলেন, এখন আমার স্বামী বলছে, তার ভুল হয়ে গেছে। তাকে যেন বের করার ব্যবস্থা করি। আমি মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সবকিছু বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, মামলার আগামী ধার্য তারিখে তিনি বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন। তখন আমার স্বামী বের হতে পারে।

আশা আরও বলেন, সেতাউরের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা না বলি। যেন চুপচাপ থাকি।

সেতাউর রহমানের সঙ্গে মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে দাবি করেন, এটি সেতাউরের নম্বর নয়। তিনি নিজের নাম সবুজ দাবি করেন। নম্বরটি নিশ্চিত হয়েই ফোন করা হয়েছে জানালে কথা বলার জন্য তিনি পাঁচ মিনিট সময় নেন। তিন মিনিট পর তিনি ফোন ব্যাক করে বলেন, ভাই, আমি এসব কিছুই জানি না। আমার মামলায় কে জেলে গেছে সেটাও আমি বলতে পারব না। আমার নামে দু-তিনটা মামলা ছিল, শেষ হয়ে গেছে।

রাজশাহী মহানগর দায়রা ও জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলী আশরাফ মাসুম বলেন, যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে মিঠুনকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি সেতাউর নন। তা না হলে তার মুক্তি নেই। যদি স্বেচ্ছায় টাকার বিনিময়ে মিঠুন কারাগারে যান তাহলে তিনি নিজেই অপরাধী। যে ব্যক্তি পাঠিয়েছেন তিনিও অপরাধী।

আইনজীবী আলী আশরাফ মাসুম আরও বলেন, যে আইনজীবীর মাধ্যমে মিঠুন সেতাউর সেজে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তার মিঠুনকে চেনার কথা নয়। তারপরও বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে এলে আদালত তাকেও কারণ দর্শাতে পারেন। কারণ, এগুলো যেমন অপরাধ তেমনি একজন ব্যক্তির মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।

সারাবাংলা/এসআর

'ভাড়ায়' জেল খাটা ‘আয়নাবাজি’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর