দাভোসে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস
আর্থিক খাতের ‘ডাকাতি’ খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল পাঠানোর আহ্বান
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:০০ | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৮
দাভোস: পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে আর্থিক খাতে কীভাবে প্রকাশ্যে ও দিবালোকে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছিল- তা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে পাঠানোর জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে দেশ থেকে পাচার হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে আনতে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ডসহ বিদেশি সুহৃদদের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন তিনি।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে অংশ নেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক ও আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ আহ্বান জানান এবং সহায়তা কামনা করেন।
এছাড়া বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পর্কেও বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেন তিনি।
বাসস জানায়, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন ডলার করে দেশ থেকে পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররা শুধুমাত্র দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এটি একটি বিশাল ‘ডাকাতি’। প্রথমে এসব ধনকুবেররা ব্যাংক দখল করে নেয় এবং পরে যে ঋণ নিয়েছে, তা আর পরিশোধ করেনি।
পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বিশ্ব নেতাদের জানান যে, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সরকার প্রাথমিকভাবে শীর্ষ ২০ জন অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া সরকার এ বিষয়ে একটি সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে।
বাসস জানায়, বুধবার (২২ জানুয়ারি) সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ডের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি জুলাই বিপ্লব ও বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়।
বৈঠকে ক্রিস্টিন লাগার্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার ও দেশে ফেরানোর জন্য আইএমএফের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন।
জার্মান মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট এর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে জার্মান সরকারের সমর্থনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র ও বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা করেন ড. মুহামম্দ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা যখন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা পরিষ্কার বাংলাদেশের কথাও বলি।
জ্বালানি নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ নেপালের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা অন্বেষণের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চায়। নেপাল সত্যিই বিদ্যুৎ বিক্রি করতে প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ একটি ভালো বাজার। এটি প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে পারে।
বৈঠকে জার্মান মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট জানান যে, আগামী এপ্রিলে একটি নতুন জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে।
সুইস ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিসের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও জলবায়ু অর্থায়নসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনাকালে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে কার্বন রোধ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য তিনি সুইজারল্যান্ড সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া বাংলাদেশের যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সুইজারল্যান্ডকে বাংলাদেশে বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট এবং জাহাজ চলাচলসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান করতে চাই। কারণ আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীদের একজন সিনাওয়াত্রা বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পর দুই দেশের মধ্যে যুব সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে তার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, থাই প্রধানমন্ত্রীর পিতা থাকসিন সিনাওয়াত্রা ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার একজন বড় ভক্ত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা থাই প্রধানমন্ত্রীকে ‘থ্রি জিরো’ ধারণা সম্পর্কে অবহিত করেন, যার লক্ষ্য দারিদ্র্য, সম্পদের ঘনত্ব, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে একটি আত্ম-ধ্বংসী সভ্যতাকে উদ্ধার করা।
অধ্যাপক ইউনূস সিনাওয়াত্রাকে বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি দেশে প্রায় ৫০০০ ‘থ্রি জিরো’ ক্লাব রয়েছে।
থাই প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন এই বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তিনি সংগঠনের পরিকল্পিত শীর্ষ সম্মেলনের সময় বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশকে আসিয়ানের একটি সেক্টরাল সংলাপ অংশীদার হতে এবং ফলস্বরূপ সংস্থার পূর্ণ সদস্য হতে থাইল্যান্ডের সমর্থন কামনা করেন।
বাসস জানায়, দাভোসে প্রধান উপদেষ্টা জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলারির প্রধান ও বিশেষ কার্যাদির ফেডারেল মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট, বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেটংটার্ন সিনাওয়াত্রা, সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল পররাষ্ট্র বিভাগের ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সংস্কৃতি ও শিল্প কর্তৃপক্ষের চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রমুখের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সারাবাংলা/আরএস