অনুমোদনের ১১ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:০৫
রংপুর: অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধ করে পরিকল্পিত ও আধুনিক নগর স্থাপন, নগরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা, তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং উন্নতর নাগরিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রায় ১ যুগ আগে ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ অনুমোদন দেয় সরকার। বছরের পর বছর গেছে, সরকার বদল হয়েছে তবুও বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখা যায়নি।
পশ্চাৎপদ রংপুরকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ রংপুরবাসী।
জানা গেছে, ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২’ এর খসড়া প্রণয়ন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দায় মেটালেও এখনও পূর্ণাঙ্গ আইন আকারে কার্যকরের অপেক্ষায় আছে খসড়া এ আইনটি।
অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অনুমোদনের পরও দীর্ঘ সময় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন না করা মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই প্রতিফলন। এতে বেড়েছে ক্ষোভ, উঠছে বাস্তবায়নের দাবি।
পিছিয়ে পড়া রংপুরকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে সব আমলেই।
২০১২ সালে রংপুর সিটি করপোরেশনের যাত্রা শুরুর পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রাস্তাঘাট, প্রশাসনিক অবকাঠামো, আবাসিক ভবন, শিল্প-কলকারখানার বিস্তার ঘটে দ্রুত। কিন্তু উন্নয়ন যা হয়েছে, তার সবই হয়েছে অপরিকল্পিত। কারণ রংপুর সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত কোন মাস্টারপ্ল্যান নেই। গঠিত হয়নি আলাদা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও। ফলে অপরিকল্পিত নগরায়নে ভবিষ্যৎ জঞ্জালের নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে এই শহর। তাই দীর্ঘদিন থেকেই ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের দাবি জানিয়ে এসেছে নগরবাসী।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৮ জুন সচিবালয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় রংপুর, সিলেট ও বরিশাল জেলায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করা হয়। এতে স্বশাসিত সংস্থা গঠনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামতের আলোকে টেকনিক্যাল কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রস্তাবিত রংপুরসহ তিনটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতে বলা হয়, বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিত ভবনের নকশা অনুমোদনসহ অন্যান্য ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে। অথচ বহুতল বিশিষ্ট ইমারত বা নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা করে বিকাশের কোনো ধারণা বা কারিগরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবল নেই। তাই জাতীয় স্বার্থে রংপুর, সিলেট ও বরিশাল এলাকার ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে যুক্তিসংগতভাবে পরিচালনা করার প্রয়োজন। কিন্তু রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের কার্যক্রম সেদিন থেকেই ফাইলবন্দি।
এরপর গত ২০২৩ সালের ১২ জুন সংক্রান্ত তৎকালীন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. অলিউল্লাহ উপস্থিতিতে ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২’ এর খসড়ার ওপর অংশীজনের নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। সেদিনের সভায় বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের মতামত দেন।
জানা যায়, ওই সভায় অতিরিক্ত সচিব অলিউল্লাহর মতামতে বলেন, ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে নৌ, বিমান, রেল, সড়ক ও মহাসড়কে যান চলাচলের গতি-প্রকৃতি, পানি সরবরাহ-সংরক্ষণ, বর্জ্য পয়ঃপ্রণালি ও পয়ঃনিষ্কাশন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরের জন্য ভূমি সংরক্ষণ ও তার অবস্থা নির্ধারণ, আবাসিক-বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার অবস্থান নির্ধারণ ও সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়নে ভবিষ্যতের জন্য ভূমি চিহ্নিতকরণ ও তার অবস্থান নির্ধারণ, ভূমি ব্যবহার, জোনিং, ভূমিকম্প সংবেদনশীলতা, প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ অনুসরণ করে ভূমি সংরক্ষণ, সৌর-বিদ্যুৎসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, দীর্ঘমেয়াদি ও আধুনিক নগর পরিকল্পনা প্রকল্পের ধারাবাহিক উন্নয়ন, নিয়মিত সংস্কার, জাতীয় পর্যটন মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আধুনিক পর্যটন ও বাণিজ্যিক নগরী নির্মাণ করা সম্ভব হবে।’
অনুমোদনের পরেও বাস্তবায়ন না হওয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, এটা অবহেলা ছাড়া কিছুই নয়। বাজেট যখন হয় তখন রংপুরের জন্য কিছুই থাকে না। এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।
তিনি বলেন, ‘যেভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে তাতে ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের পর বরাদ্দ পেয়ে সেসব অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে সেখানে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন তৈরি ২০১৪ সালে শুরু হলেও অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। যেখানে রাজশাহী ওয়াসা বরাদ্দ পাচ্ছে সেখানে রংপুর ওয়াসা গঠন নিয়ে আদৌ চিন্তাভাবনা কেউ করছে বলে জানা নেই, কোনো জনদাবিও নেই। এরকম প্রতি খাতেই হাজার কোটি টাকার বৈষম্যের শিকার রংপুর বিভাগ।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘পশ্চাৎপদ রংপুরকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদানের জন্য ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
আলাদা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ না থাকায় নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে এটি বাস্তবায়নে সব পক্ষের ঐকান্তিক ইচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের সদ্যবিদায়ী মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
তিনি বলেন, ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও এখনও আলোর মুখ না দেখা মানে বোঝা যায় সব পক্ষের গাফিলতি এটি। ১০ বছর আগে এই আইনের খসড়া গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন হলেও অজানা কারণে ঝুলে আছে। রংপুরের মানুষের জনদাবির প্রেক্ষিতে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। সবাই চাইলে এটা অবশ্যই এত দিনে হয়ে যেত।
সারাবাংলা/এসআর