ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে শুল্কারোপ
হাজার টাকায় খরচ বাড়ল ১০০ টাকারও বেশি
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০৯ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:০১
ঢাকা: সম্প্রতি শতাধিক পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এতে মোবাইল ফোনে কথা বলা, রেস্তোরাঁর খাবার, সিগারেট, পোশাক, এলপি গ্যাস, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে মোবাইল ইন্টারনেটসহ দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টানেটের খরচও। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে নতুন করে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় গ্রাহক পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে। ৫০০ টাকার প্যাকেজে গ্রাহককে আগে খরচ করতে হতো ৫২৫ টাকা। এখন সেটা হবে ৫৭৭ টাকারও বেশি। আর হাজার টাকার প্যাকেজের বর্তমান দাম পড়বে ১ হাজার ১৫৫ টাকা। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্রান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহার কমবে বলে আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া, গ্রাহক হারাতে পারেন ইন্টারনেট সেবাদতারাও। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বর্তমান অন্ততবর্তী সরকার বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে। এসব অধ্যাদেশের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় শতাধিক পণ্যে নতুন করে শুল্ক ও কর আরোপ করা হয়েছে।
সাধারণত নতুন অর্থবছরে বাজেটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ও কর কমানো-বাড়ানো হয়। তবে, জাতীয় সংসদ না থাকায় অন্তর্বর্তী সরকার তার ব্যয় মেটাতে এসব অধ্যাদেশ জারি করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে দাম বাড়ানো হয়েছে এমন পণ্যের ওপরও নতুন করে শুল্ক ও করারোপ করা হয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাংলাদেশে এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি আরও তুঙ্গে উঠবে। নতুন এই ভ্যাট হারে দেশের জনগণ আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারেন।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে ১০ শতাংম সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া ইন্টারনেটে ব্যবহার্য আনুষাজ্ঞিক অন্যান্য বিষয়েও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব সরাসরি গ্রাহকের ওপর পড়বে। আর অন্যান্য প্রভাব পড়বে আমরা যারা ইন্টারনেট সেবা দিই তাদের ওপর (অপারেটর)।’
তিনি বলেন, ‘৫০০ টাকা প্যাকেজের দাম বেড়ে এখন হবে ৫৭৭ দশমিক ৫ টাকা এবং ১ হাজার টাকার প্যাকেজে গ্রাহককে এখন খরচ করতে হবে ১ হাজার ১৫৫ টাকা। সবগুলো প্যাকেজেই এই হারে দাম বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছি, করপোরেট ট্যাক্স, এআইটি ও সবকিছিু মিলিয়ে শতকরায় ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে। এক এমবিপিএস সেবা দিয়ে আমরা যে টাকা পাই তার ৫০ ভাগের কিছু বেশি পায় সরকার। অর্থাৎ গ্রাহক সেবার বিনিময়ে যে অর্থ দিচ্ছে, সেখানে অর্ধেকের বেশিই কর। ফলে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপারেটররাও। এতে গ্রাহক হয়তো ইন্টারনেটের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারে। আর সবকিছুতে ভ্যাট বাড়ায় অপারেটররাও হয়তো তাদের সার্ভিস কোয়ালিটি কমিয়ে দিতে পারে।’
আইএসপিএবি সভাপতি বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রির স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করে এভাবে হঠাৎ শুল্কারোপ করা ঠিক হয়নি। আমরা আশা করব, সরকার ব্রডব্যান্ড প্যানেট্রেশন বাড়ানোর জন্য হলেও ১০% সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো থেকে বিরত থাকবে। এ ব্যাপারে আমরা ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
এ বিষয়ে আইএসপিএবি’র পরিচালক ফুয়াদ মোহাম্মদ শরফুদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা দিই, ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় তারা সমস্যায় পড়ব। যখন নতুন বিলে ওই ভ্যাট অ্যাড করে দেব, তখন গ্রাহক বিল দিতে চাইবে না। এতে গ্রাহক ও আমাদের মধ্যে একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা গ্রাহক হারাতে পারি। কারণ লাস্ট মাইলে আমরা কাজ করি। বেশি সমস্যা আমাদের।’
আরও পড়ুন:
- শতাধিক পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি
- ভ্যাট বাড়লে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধের হুঁশিয়ারি
- গ্যাসের মূল্য ও শুল্ক বাড়লে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে: ঢাকা চেম্বার
- ফের বাড়ছে মোবাইল খরচ, ১০০টাকা রিচার্জে পাওয়া যাবে ৪৪ টাকা!
- দেশীয় ফ্রিজ, এসি ও মোটরসাইকেল শিল্পে কর বৃদ্ধি, দাম বাড়তে পারে
আইএসপিএবির তথ্য মতে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিসে প্রকিউরমেন্ট প্রোভাইডারে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপে ভ্যাট ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। প্রিন্টিংয়ে ভ্যাট ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, রিপেয়ার ও মেইন্টেন্সে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, ক্লিনিং সার্ভিসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, লোকাল ট্রেডিংয়ে ভ্যাট ৫ থেকে বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও মেডিসিনে ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আর ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারে সম্পূরক শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারে খরচ আরও বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে ১০০ টাকা রিচার্জে গ্রাহকরা ৪৩ টাকার কিছু বেশি ব্যবহার করতে পারবেন। বাকি অর্থ যাবে সরকারের কোষাগারে। আর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার আরও কমে যাবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সম্পূরক শুল্ক আরও তিন শতাংশ বাড়ায় মোট কর হবে ৫৬ দশমিক ৩ টাকা। যার মধ্যে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ কাটবে ২৯ দশমিক ৮ টাকা। রেভিনিউ শেয়ার ও মিনিমাম ট্যাক্স কাটবে ৬ দশমিক ১ টাকা, পরোক্ষ কর কাটবে ২০ দশমিক ৪ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সবমিলিয়ে কর দিতে হবে ৫৬ দশমিক ৩ টাকা। ফলে গ্রাহক ১০০ টাকায় ব্যবহার করতে পারবেন মাত্র ৪৩ দশমিক ৭০ টাকা।
মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেটে সম্পূরক বৃদ্ধি এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেকেরই আয় কমেছে। এমনিতেই অনেকে এখনো মুঠোফোন সেবার বাইরে রয়েছেন। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে। অনেকেই মোবাইল সেবা থেকে আরও বিচ্ছন্ন হয়ে যাবেন। ব্রডব্যান্ড ব্যবহাকারীও কমবে।’
জানতে চাইলে বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবস’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত হতাশাজনক। দুই সপ্তাহ আগে কায়রোতে ডি-৮ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন যে, তার নতুন সরকার তরুণ প্রজন্মকে দিয়ে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা তৈরির কাজ করছে। আগামীতে এই তরুণ উদ্যোক্তারা ইন্টারনেট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা দিবে। এ জন্য উদ্যোক্তা ও তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহারকে সহজতর করতে সরকার কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা মুখে বলছেন, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো সেই কথার সঙ্গে মিলছে না। এখানে দেখা যাচ্ছে, সরকারের উপর মহলের প্রত্যাশার সঙ্গে আমলাদের নেওয়া সিদ্ধান্তের মিল নেই। আমলাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা এসব সিদ্ধান্তে মর্মাহত। আগামী রোববার আমরা মানবন্ধন করব। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন, ভয়েস ফর রিফর্মসহ অনেক সংগঠন ও অনেকেই ওই মানববন্ধনে অংশ নেবে।’ ছাত্রদেরও ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম