Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রশাসন: ফিরে দেখা ২০২৪
অস্থিরতা মাথায় নিয়ে বিদায় নিচ্ছে পুরনো বছর

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:১০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৪০

ঢাকা: বছরের শুরুটা হয়েছিল একটি বির্তকিত সংসদ নির্বাচন দিয়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসন সাজানো, সরকারপন্থি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়নের পাশাপাশি ভিন্ন মতাদর্শের কর্মকর্তাদের ওএসডি, বদলি, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা বছরের শুরুতেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এরইমধ্যে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূখে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং নতুন অন্তর্বতী সরকার গঠনের পর প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল শুরু হয়। সেই রদবদলে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা গত প্রায় পাঁচ মাসেও সমাধান হয়নি। এই বিশৃংখলা মাথায় নিয়েই বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল।

বিজ্ঞাপন

শুরুটা ডিসি নিয়োগ নিয়ে

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগষ্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া ১১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয় একদিনে। এরপর থেকে শুরু হয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল। সেই রদবদলে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক অবসরে, আবার কিছু কর্মকর্তাকে করা হয় ওএসডি। অনেককে বদলি করে অন্যত্র পাঠানো হয়। আবার সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা হয় হত্যা মামলা।

বিজ্ঞাপন

সেই মামলায় গ্রেফতার হোন ১২ জন সাবেক আমলা। যা প্রশাসনে ছিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। প্রশাসন সংস্কারের এ উদ্যোগে পরিবর্তন আনা হয় মাঠ প্রশাসনেও। দুই দিনে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৫১ জেলায় নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর নিয়ে বিক্ষুদ্ধ হন নিয়োগ বঞ্চিত কিছু কর্মকর্তা। উপসচিব পর্যায়ের ওই সকল কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে তাৎক্ষনিকভাবে আট জেলার ডিসি নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। ওই ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। যা অন্তর্বতী সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওই অভিযোগ প্রমাণ করা না গেলেও অভিযুক্ত দুই যুগ্ম সচিবকেই বদলি করা হয়।

ওএসডি, মামলা আতঙ্ক

প্রশাসনের রদবদলে ওএসডি, বদলি, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ছিল কর্মর্কতাদের মধ্যে উদ্বেগ। ছিল মামলা আতঙ্ক। গত সাড়ে চার মাসে সাবেক সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রশাসনে এবারই প্রথম এতো সংখ্যক কর্মকর্তা গ্রেফতার হন। এবারই সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সচিবদের নামে। মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ মুখ্য সচিবের নাম ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকি দুজন আত্মগোপনে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও নজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। অন্য দুই মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং আহমেদ কায়কাউস এই দুইজনের একজন দেশের বাইরে, অন্যজন আত্মগোপনে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা দুই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও কবির বিন আনোয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

ঢালাওভাবে নিয়োগ, পদোন্নতি

গত প্রায় পাঁচ মাসে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সচিব করা হয়েছে ২৩ কর্মকর্তাকে। গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৭ জন। এদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৪ জন। পাশাপাশি ১৪টি মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে। বিগত সরকারের সময়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হলেও অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে নানা মহলে সমালোচিত হয়েছে প্রশাসন। আবার সকালে নিয়োগ বিকেলে বাতিলের ঘটনাও ছিল সমালোচিত। সাড়ে চার মাসে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বদলির আদেশ পরে প্রত্যাহার করতে হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে।

এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা ছিল, বিগত সরকারের সময়ের চুক্তিভিত্তিক সকল নিয়োগ বাতিল করা হবে। সে অনুযায়ী শতাধিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। তবে একই সময়ে আবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে তাদের অনেকের প্রশাসনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জন সাবেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত কমিটি। সচিব পদে ১১৯ জনকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

ক্ষুব্ধ প্রশাসন

গত ১৭ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে। সেখানে কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, উপ-সচিব পদে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতি হবে ৫০/৫০ অনুপাতে। আর সেখানে পদোন্নতি নিতে হবে পরীক্ষা দিয়ে।

একই সভায় কমিশনের সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান জানিয়েছিলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার আলাদা করার সুপারিশ করবে কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান ও সদস্যের এই বক্তব্যে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা স্পষ্ট বলেছেন ৫০ শতাংশ ৫০ শতাংশ অনুপাত চান না। আবার আলাদা হতে চান না শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রশাসনের বাইরে থাকা ২৫ ক্যাডার নিয়ে গঠিত আন্তঃ ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। তাদের দাবি বর্তমানের এই পদোন্নতির বিধান বিলুপ্ত করা।

সচিব নেই চার মন্ত্রণালয়ে

অন্তবর্তী সরকার এরই মধ্যে সাড়ে চার মাস সময় পার করেছেন। সচিবহীন চার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে গত অক্টোবরে ওএসডি করা হয়। তার এক মাস পর নভেম্বরে ওএসডি করা হয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব শাহানারা খাতুনকে। এখন পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের দুইটি বিভাগের কোনোটিতেই সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সচিব নেই সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সেতু বিভাগেও। একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ন পদ। যার তদারকিতে ওই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাজ তরান্বিত হয়, গতিতে থাকে। গত কয়েক মাস এই সকল মন্ত্রণালয়গুলোতে সচিব না থাকায় কাজে ধীরগতি নেমে আসছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদের বাইরেও সচিবালয়ের কর্মচারীদের সংগঠনও তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে সরব থেকেছেন গত চার মাসে। আবার কোণঠাসা কর্মকর্তারা ভালো পদায়নের প্রত্যাশায় সিনিয়রদের কাছে ধারণা দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে কর্মকর্তাদের ভিড় লেগে রয়েছে এখনো।

সারাবাংলা/জেআর/ইআ

অস্থিরতা জনপ্রশাসন ডিসি নিয়োগ পদায়ন ও বদলি