ভরা মৌসুমেও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী, এক বছরে বেড়েছে ১৫%
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০১
রাজশাহী: বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জিতে অগ্রহায়ণের শুরু হলে শুরু হয় নবান্ন উৎসবও। খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জি হিসেবে সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। ঠিক এই সময়ে আমন ধান কেটে ঘরে তুলতে থাকেন কৃষকরা। সেই কর্মযজ্ঞ চলছে থাকে মাস দুয়েক। সে হিসাবে পৌষের মাঝামাঝি কিংবা ডিসেম্বরের শেষের এই সময়টাকে বলা যায় আমনের ভরা মৌসুম।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের দুর্যোগে ফলন খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এই সময়ে চালের সরবরাহ বেড়ে যায়। ফলে আমনের এই ভরা মৌসুমে চালের বাজারদর থাকে নিম্নমুখী। বাজারের তথ্য বলছে, চালের সরবরাহে ঘাটতি নেই এ বছরেও। তবে আমনের ভরা মৌসুমেও শহর থেকে গ্রাম— সবখানেই চালের দাম বাড়তির দিকে। শুধু তাই নয়, এক বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ।
গতকাল রোববার (২৯ ডিসেম্বর) রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন চালের আড়ত ও দোকান ঘুরে জানা যায়, গত বছর আটাশ জাতের চালের ৫০ কেজি বস্তা বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকায়। এ বছর এই চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ টাকায়।
এদিকে মোটা চাল তথা গুটি স্বর্ণার দাম ছিল ৫০ কেজির প্রতি বস্তা দুই হাজার ৪০০ টাকা, যা এ বছর বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার টাকায়। একইভাবে জিরাশাইল চালের ৫০ কেজি বস্তার দাম তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৭০০ টাকা। সব মিলিয়ে সব চালেই ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
মিল মালিকরা বলছেন, মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা আটাশ চাল (৫০ কেজির বস্তা) বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ২৫০ টাকা থেকে তিন হাজার ৩৫০ টাকায়। মোটা চাল বা গুটি স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৭৫০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায়। অন্যদিকে জিরাশাইল চাল এখন বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৫০০ টাকায়।
আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার পর মিলগেটের এই দর বস্তা প্রতি বেড়ে যাচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে আরও এক দফা দাম বাড়লে মিল থেকে ক্রেতার কাছে যেতে যেতে প্রকারভেদে বস্তায় ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে চালের।
চালের দামের এমন বেসামাল দশা হলেও চাল ব্যবসায়ীরা দুষছেন একে অন্যকে। পাইকারি চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিকরা দাম বাড়াচ্ছে। মিল মালিকরা বলছেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন পাইকারদের।
খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭২ থেকে ৭৫ টাকা দরে। গুটি স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা ও জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা দরে।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, কখনো সরবরাহ সংকট, আবার কখনো ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমনের ভরা মৌসুমে সংকটের কথা বলে আবারও চালের দাম বস্তায় সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারিতেও বেশি টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ থেকে আট টাকা।
নগরীর সাগরপাড়া এলাকার অমিত স্টোরের স্বত্বাধিকারী অমিত সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আড়ত থেকে চাল কিনতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। এক মাসের মধ্যে চালের দামও বেড়েছে। প্রতি বস্তায় ৫০০ টাকা করে বাড়তি গুনতে হচ্ছে। আবার বাড়তি দামে বিক্রি করা হলে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।’
নগরীর সাহেববাজারের এপি চাউল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী প্রকাশ প্রসাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিল থেকে চাল নিয়ে এসে বিক্রি করছি। গত কয়েক বছরে চালের দাম বেশ বেড়েছে। মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা উপকৃত হচ্ছেন চালের দাম বাড়িয়ে। ওখানে যদি কম দামে কেনা যায়, তাহলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারব।’
অন্যদিকে নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল বিক্রেতা সততা এন্টারপ্রাইজের মালিক সোলায়মান আলী বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়ছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কম দামে কিনতে পারলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারব।’
মিলারদের ধানের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপানের কথা উঠে এলে কামাল অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেনের কণ্ঠে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে রেখেছেন। তারা বাড়তি দাম না পেলে ধান ছাড়ছে না। ফলে তাদের কাছে বেশি দামে ধান কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। আমাদের খরচও আছে। এ কারণে দাম বাড়ছে।
রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামও ধানের দামকেই দায়ী করছেন চালের বাড়তি দামের নেপথ্যের কারণ হিসেবে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল প্রক্রিয়াজাতকরণে বেশি খরচ হচ্ছে। কৃষকদের পাশাপাশি ধানের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এখন ধান মজুত করছে। দাম বেশি না হলে তারা বাজারে ছাড়ছেন না। এ কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।’
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজশাহীর উপপরিচালক ইব্রাহিম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের অভিযান চলছে। চাল ব্যবসায়ীদের সতর্কও করা হচ্ছে। এরপরও যারা সতর্ক হচ্ছে না তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’
সারাবাংলা/টিআর